আফ্রিকায় প্রতি মিনিটে ম্যালেরিয়ায় ভুগেই মারা যায় অন্তত দু'জন শিশু৷ তাই মশার কামড় থেকে মানুষকে বাঁচাতে সারা দিনমান কাজ করছে তাঞ্জানিয়ার ছোট্ট শহর ‘সিটি অফ মসকিটো', অর্থাৎ ‘মশার নগর'৷
বিজ্ঞাপন
তাঞ্জানিয়ার প্রত্যন্ত এক শহর ইফাকারা৷ ইফাকার শব্দের অর্থ ‘যেখানে আমি মৃত্যু বরণ করি'৷ নামেই বোঝা যায় বসবাসের জন্য শহরটি আসলে কেমন৷ মানুষ যেন সেখানে জীবন উপভোগের কথা, সুখে-স্বাচ্ছ্যন্দে কিছুদিন বাঁচার কথা ভাবতেই পারে না, জন্মের পর থেকে আসল কাজই যেন মশার কামড়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করা৷
সেখানে মশার কবল থেকে মানুষ বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ইফাকারা হেল্থ ইন্সটিটিউট (আইএইচআই)৷ তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মশা এবং মশাবাহিত রোগে মৃত্যুহার অনেক কমেছে৷ কতটা কমেছে তা জানানোর আগে শহরটিতে মশা কত বেশি ছিল সে সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক৷ আইএইচআই-এর গবেষক বলছিলেন, ‘‘আমি যখন এখানে কাজ শুরু করি, তখন আলোর ফাঁদ পেতে যে মশাগুলো ধরা হতো, সেগুলো গুনে শেষ করা যেত না৷ প্রতিদিন ওজন করা হতো৷ কোনো কোনো রাতে মশা সংগ্রহের ব্যাগ ভরে মশা উপচে পড়তো৷''
কেন আপনাকে মশা কামড়ায়?
অনেকেরই অভিযোগ, অন্যদের তুলনায় মশা তাদের বেশি কামড়ায়৷ সাধারণত অনেকেই বলে শরীরে নাকি মধু আছে, তাই এত মশা কামড়ায়৷ কিন্তু গবেষকরা কী বলছেন জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance/F. May
রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন এলএসএইচটিএম-এর নতুন গবেষণা বলছে, যাদের রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ, মশা তাদের বেশি কামড়ায়৷ বলা হচ্ছে ‘ও’ পজেটিভ গ্রুপ যাদের তাদের রক্তে এমন কোনো পদার্থ আছে, যা মশাকে আকর্ষণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Gathany
শ্বাস-প্রশ্বাস
গবেষকরা বলছেন, যারা বড় বড় শ্বাস নেন ও ছাড়েন তাদের মশা বেশি কামড়ায়৷
ছবি: Colourbox
স্টেরয়েড ও কোলেস্টেরল
এছাড়া যাদের দেহে স্টেরয়েড ও কোলেস্টোরলের মাত্রা বেশি তাদের মশা বেশি কামড়ায়৷
মশা গর্ভবতী নারী ও যাদের ওজন বেশি তাদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়৷
ছবি: Fotolia/Subbotina Anna
প্রচুর ঘাম
যারা বেশি ব্যায়াম করে এবং প্রচুর ঘামে, তাদের মশা বেশি আকর্ষণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিয়ার পান করা
যারা বেশি বিয়ার পান করে, তাদের বেশি মশা কামড়ায়৷
ছবি: picture alliance/F. May
6 ছবি1 | 6
তবে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে৷ গত ১৭ বছরে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুহার ৬০ ভাগ কমেছে৷ মশার কামড়ে সংক্রমণও কমেছে শতকরা তেত্রিশ ভাগ৷ আরেক হিসেব বলছে, ১৯৮০ সালে ইফাকারায় একজন মানুষের প্রতি বছর গড়ে যেখানে ২০০০ সংক্রামক মশা কামড়াতো, সেখানে এখন বছর কামড়ায় মাত্র ১৮টি সংক্রামক মশা৷
শুধু তাঞ্জানিয়ার ইফকারায় নয়, মশাবাহিত রোগ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সারা বিশ্বেই৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের তুলনায় বিশ্বে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে থাকা এবং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত শতকরা ১৮ ভাগ কমেছে৷ কমলেও এখনো যা রয়েছে সেই সংখ্যাই অবশ্য রীতিমতো ভীতিকর৷ ২০১৬ সালে সারা বিশ্বে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে ছিল অন্তত ৩২০ কোটি মানুষ এবং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কমপক্ষে ২১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ৷
ভারত-বাংলাদেশে মশা, মশার কামড় অথবা ম্যালেরিয়া নতুন কিছু নয়৷ আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আফ্রিকায় প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে মারা যায় এক জন শিশু৷ অথচ এ রোগ প্রতিরোধে আজও কোনো টিকা বের হয়নি৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Cabezas
মশার আক্রমণ
আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীর নাম এনোফিলিস মশা৷ লম্বায় ছয় মিলিমিটার এই মশা ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী৷ প্রতি বছর সারা বিশ্বের প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এ রোগে মারা যায়৷
ছবি: imago/blickwinkel
বৃত্তাকারে ঘোরা
হলুদগুলো জীবাণু৷ আর নীলগুলো জীবাণুর চলার পথ৷ গবেষকরা কতগুলো জীবাণুকে তরলপূর্ণ একটি গ্লাসে ছেড়ে দিয়েছেন৷ জীবাণুগুলো বাঁকানো বলে তারা একটি বৃত্তের মধ্যে ঘুরছে৷ মাত্র ৩০ সেকেন্ডে তারা বৃত্ত পূরণ করতে পারে৷
ছবি: Colourbox
কামড় খাওয়ার ১২ দিন পর মৃত্যু
মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ঢোকার পর সেটা কিছুদিন যকৃতে বাসা বাঁধে৷ কিন্তু যার শরীরে ঢোকে সে টের পায় না৷ যকৃতে গিয়ে জীবাণুগুলো রক্তকোষকে আক্রমণ করে শরীরকে অসুস্থ করে ফেলে৷
ছবি: AP
রক্তধারায় জীবাণু
শরীরে ঢোকার এক থেকে তিনদিনের মধ্যে জীবাণুগুলো রক্তকোষ ভেঙে ফেলে৷ ফলে জ্বর হয়৷ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে রোগ নির্ণয় করা সহজ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Ordonez
জীবন রক্ষাকারী
ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় মশার কামড় না খাওয়া৷ ক্রিম ও স্প্রে ব্যবহার এবং মশারি খাটিয়ে ঘুমানো এক্ষেত্রে ভালো ফল দিতে পারে৷
ছবি: DW/A.Bacha
দ্বিগুণ সুরক্ষা
গবেষকরা বিশেষ ধরণের মশারি তৈরি করেছেন যার সুতায় কীটনাশক লাগানো আছে৷ ফলে মশা মশারির উপর বসলেই মারা যাবে৷
ছবি: Kerry Skyring
কঠোর পদক্ষেপ
মশা দমনে মুম্বইয়ে কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে৷ কিন্তু মশা মারতে এটা কার্যকর হলেও স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর৷ যেখানে কীটনাশক ছিটানো হয় সেখানকার খাদ্য চক্রের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷
ছবি: Reuters
দ্রুত রোগ নির্ণয়
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ম্যালেরিয়া শনাক্ত করা যায়৷ আফ্রিকার দেশ মালিতে একটি ছেলের শরীরে ম্যালেরিয়া জীবাণু ঢুকেছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সময়ের সঙ্গে পাল্লা
ওষুধের মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধ্বংস করা যায়৷ কিন্তু সময় যত বাড়ছে জীবাণুগুলো ততই ওষুধের বিরুদ্ধে জয়ী হচ্ছে৷ অর্থাৎ ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে৷ যেমন ‘ক্লোরোকুইন’ নামের একটি ওষুধ বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের দেহে আর কার্যকর হচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Mukherjee
ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিন?
ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এখনো কোনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি৷ তবে গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন৷ তারা খুব শীঘ্রই এতে সফলতা আশা করছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Cabezas
10 ছবি1 | 10
ইফাকারার অধিকাংশ মানুষই খুব গরিব৷ তাঁদের ঘরগুলোও খুব ছোট ছোট৷ বেশির ভাগ মানুষই বাস করেন এমন ঘরে যেখানে একটি বা দু'টি বিছানা পাতার পর আর জায়গা থাকে না৷ ফলে ঘুমানো ছাড়া বাকি সব কাজই করতে হয় ঘরের বাইরে৷
আইএইচআই তাই মশা ধরতেও মানুষকে কাজে লাগায়৷ অল্প পারিশ্রমিকে অনেকেই ঘরের বাইরে বিশেষ ধরনের মশারির নীচে বসে থাকেন৷ মশারির সঙ্গে এক ধরনের মশা ধরার ফাঁদের সংযোগ থাকে৷ ফলে মানুষের রক্তের লোভে মশারিতে বসতে গিয়েই ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা৷
টাকার বিনিময়ে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের বাইরে মশারির নীচে বসিয়ে রেখেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছিল না৷ তাই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হলো বিষ মাখানো মশারি৷ এক সময় মশারি যে মরণফাঁদ তা-ও টের পেয়ে গেল মশা৷ তাই মানুষ যখন ঘুমাতে যায় তার ঠিক আগে এবং ভোরে যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন রক্তক্ষুধা মেটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তারা৷ অবস্থা সামাল দিতে তাই এবার এসেছে ‘মসকিটো ল্যান্ডিং বক্স' (এমএলবি)৷ কাঠের তৈরি কালো রঙের এ এমন এক বাক্স, যা আসলে মশা মারার নতুন ধরনের ফাঁদ৷ বাক্সে যাতে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে বসে, সে ব্যবস্থা করতে অভিনব উপায়ে বাতাসে ছড়নো হয় মানুষে ঘামের গন্ধ৷ সেই গন্ধ পেলেই মশারা ভাবে বুঝি যন্ত্রটির ভেতরেই রয়েছে তাদের ‘সুস্বাদু' খাবার৷ খাবারের লোভে উড়ে এসে বসলেই তাদের জীবনাবসান৷
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী কয়েকটি প্রাণী
হাঙর দেখলে আমরা অনেকেই ভয় পাই৷ কিন্তু জানেন কি, হাঙরের আক্রমণে প্রতিবছর কতজন ব্যক্তি মারা যায়? কিংবা বাঘ, সিংহ, সাপের হামলায়? ছবিঘরে থাকছে সে তথ্যগুলো৷
ছবি: AP
মশা
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণীর তালিকায় সবার আগে থাকছে মশার নাম৷ কি অবাক হচ্ছেন? তাহলে জেনে নিন যে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়৷ এছাড়া ডেঙ্গু, পীতজ্বর, এনসেফালাইটিস বা মস্তিষ্কপ্রদাহ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও প্রায় সোয়া লক্ষ মানুষ৷
ছবি: Fotolia/Kletr
মানুষ
হ্যাঁ৷ এই আধুনিক যুগে এসেও মানুষই মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে৷ প্রতিবছর প্রায় পৌনে পাঁচ লক্ষ মানুষ অন্য মানুষের হাতে প্রাণ হারায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাপ
সব সাপ প্রাণঘাতী নয়, এমনকি অনেক প্রজাতির সাপের কামড়ে বিষও থাকে না৷ কিন্তু যাদের আছে তাদের কামড়েই প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/blickwinkel/B. Trapp
কুকুর
কুকুরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জলাতঙ্ক রোগের নাম৷ এর টিকা আবিষ্কৃত হলেও এখনও এই রোগে প্রতিবছর মারা যান প্রায় ২৫ হাজার জন৷
ছবি: picture-alliance/ZB/B. Wüstneck
মিঠাপানির শামুক
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দূষিত পানির সংস্পর্শে গিয়ে মূলত শিশুরা একধরণের অসুখে ভোগে, যা কখনও কখনও মৃত্যুর কারণও হয়ে থাকে৷ মিঠাপানির শামুক থেকে নিঃসৃত প্যারাসাইট বা পরজীবী দূষিত পানির সঙ্গে মিশে থাকায় সিসটোসোমিয়াসিস নামক একটি রোগ হয়ে থাকে৷ এতে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার জনের মৃত্যু হয়৷
ছবি: imago/McPHOTO
কেঁচোকৃমি
বিভিন্ন ধরণের কৃমির মধ্যে কেঁচোকৃমি সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী৷ এর সংক্রমণে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি৷
ছবি: CDC
ফিতাকৃমি
এই জাতের কৃমির সংক্রমণে মারা যায় প্রায় দুই হাজার মানুষ৷ কেঁচোকৃমির মতো ফিতাকৃমিতেও শিশুরাই বেশি সংক্রমিত হয়৷ কৃমিজাত রোগ থেকে মুক্তি পেতে উন্নত শৌচাগার ও যথাযথ মল নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Loznak
কুমির
হাঙর, সিংহ কিংবা বাঘের মতোই কুমিরকে ভয় পান অনেকেই৷ অবশ্য পাওয়ারই কথা৷ কারণ কুমিরের হামলায় নিহত হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় এক হাজার৷
ছবি: Fotolia/amnachphoto
জলহস্তী
দেখতে হয়ত ততটা ভয়ংকর নয়, কিন্তু তাদের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়৷ কারণ সুযোগ পেলেই আক্রমণাত্বক হয়ে উঠতে পারে জলহস্তী৷ প্রতিবছর প্রায় পাঁচশো মানুষের জীবনের অবসান ঘটায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa-Zentralbild
হাতি
দেখতে গোবেচারা গোছের৷ কিন্তু মাঝেমধ্যেই হিংস্র হয়ে ওঠে হাতি৷ বুনোহাতির হামলায় মানুষের নিহত হওয়ার খবর আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি৷ প্রতিবছর এভাবে প্রায় একশোজনের প্রাণ যায়৷
ছবি: Reuters/A. Lee
হাঙর
হাঙরকে দেখতে যতই ভয়ংকর মনে হোক, মানুষের যেহেতু তাদের কাছাকাছি যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, তাই হাঙরের হামলায় মানুষের প্রাণ যাওয়ার ঘটনাও খুব বেশি ঘটেনা৷ সংখ্যাটা প্রতিবছর ১০ জনের মতো৷