রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকেই ইউক্রেনের বন্দর নগরী মারিউপল বড় ধরনের সংকটের মুখে রয়েছে৷ সেখানে বাড়তি বিড়ম্বনা হিসেবে যোগ হয়েছে কলেরা৷
বিজ্ঞাপন
ইউক্রেনের মারিউপলে স্বাস্থ্য পরিষেবা বিপর্যস্ত, এমনটাই জানিয়েছেন সেখানকার মেয়র ভাদিম বয়চেঙ্কো৷ জাতিসংঘ জানিয়েছে, শহরের বেশিরভাগ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং বিশুদ্ধ পানির লাইন নর্দমার সঙ্গে মিশে গিয়েছে৷
ইউক্রেনের টেলিভিশেন দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বয়চেঙ্কো বলেন, ‘‘পেটের পীড়া এবং কলেরার প্রাদুর্ভাব রয়েছে৷ আমাদের চিকিৎসকদের ধারণা, যুদ্ধের ফলে ২০ হাজারেরও বেশি বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে৷ এই সংক্রমণের ফলে আরো হাজার হাজার মারিউপলবাসীর মৃত্যু হতে পারে৷''
বয়চেঙ্কো বর্তমানে মারিউপলে নেই৷ তার কথায়, ‘‘এই শহরটি কোয়ারেন্টিনে রয়েছে৷''
গত মাসে বয়চেঙ্কো বলেছিলেন, রাশিয়ান বোমাবর্ষণে মারিউপল শহরটি ‘মধ্যযুগীয় ঘেটো'তে পরিণত হয়েছে৷ পানীয় জল এবং পয়ঃনিষ্কাশন না থাকায় কূপের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন বাসিন্দারা৷ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷ মানবিক করিডোর স্থাপন করে বাসিন্দাদের শহর ছেড়ে যেতে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন৷ বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সরবরাহেরও অভাব রয়েছে এই শহরে৷
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে মা-মেয়ে
01:48
গত মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মারিউপলে কলেরার প্রাদুর্ভাব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল৷ ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শুক্রবার জানায়, মারিউপলে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রায় বিপর্যস্ত এবং এই শহরে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে৷ অধিকৃত অঞ্চলের জনগণকে ন্যূনতম পরিষেবা দিতে পারছে না রাশিয়া, এমনটাও জানায় তারা৷ কলেরা সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির কারণে হয়৷
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গেও এটির সম্পর্ক রয়েছে৷ মৃতদেহ সংগ্রহ না করার ফলে পরিস্থিতি আরো অস্বাস্থ্যকর হয়ে গিয়েছে, এমনটাও মনে করছে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়৷
রাশিয়া হামলা চালানোর পর প্রাণ বাঁচাতে নিজের দেশ ছেড়েছেন তারা৷ ইউক্রেন ছেড়ে আসা এমন কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ জার্মানিতে কষ্টের জীবন এবং স্বদেশ থেকে দূরে থাকার বেদনার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন তারা...
ছবি: DW
‘আমি বাড়ি ফিরতে চাই’
২৩ বছর বয়সি ওলেক্সান্দ্রা কিয়েভ ছাড়েন গত ২৩ মার্চ৷ জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর বার্গিশ গ্লাডবাখে তার ভালো লাগছে না, প্রতি মুহূর্তে দেশে ফিরতে ইচ্ছে করছে তার, ‘‘আমি বাড়ি ফিরতে চাই, কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব নয়৷ তবু মনে হয় সব ছেড়েছুঁড়ে কিয়েভে ফিরে যাই৷’’ পরদেশে থাকা খুব কষ্টের, তবু একটা কারণে জার্মানিতে থাকছেন ওলেক্সান্দ্রা, ‘‘ইউক্রেনকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য তো অনেক মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে৷’’
ছবি: DW
‘ঈশ্বর, আরেকটা দিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখো’
কিয়েভের এক সাবওয়ে ধ্বংস হয়ে গেল বোমায়৷ বোমার প্রচণ্ড আঘাতের ধাক্কা তার বাড়িতেও লাগলো৷ ঘরের দেয়াল এমন কেঁপে উঠলো যে আতঙ্কে জেগে উঠলেন ওলেক্সান্দ্রা৷ ২৩ মার্চ সেই যে কিয়েভ ছাড়লেন আর সেখানে ফেরা হয়নি৷ প্রথমে গিয়েছিলেন লভিভে৷ সেখানেও বোমাবর্ষন শুরু হলে ওলেক্সান্দ্রা আশ্রয় নেন সেলারে৷ সেদিন শুধু একটাই প্রার্থনা করেছিলেন ওলেক্সান্দ্রা, ‘‘ ঈশ্বর, আরেকটা দিন দেখার জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখো৷’’
ছবি: DW
আন্ডারগ্রাউন্ড কারপার্কে কাটানো দিনগুলো
লভিভে বোমাবর্ষন শুরুর পর কিছুদিন এক আন্ডারগ্রাউন্ড কারপার্কে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল৷ সঙ্গে যেটুকু খাবার ছিল, দুদিনেই সব শেষ৷ তারপর না খেয়ে থাকতে থাকতে শরীর এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে চুল বাঁধার শক্তিও ছিল না হাতে৷ কার পার্কের কয়েকদিনের জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওলেক্সান্দ্রা আরো জানান, ‘‘ সেখানে একটা টয়লেট আর থালাবাসন ধোয়ার জন্য একটা বেসিন ছিল৷ গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না সেখানে৷’’
ছবি: Privat
‘আবার যুদ্ধের কবলে পড়বো কখনো ভাবিনি’
ওলেনা নিজের সন্তানদের নিয়ে কিয়েভ ছেড়েছেন গত ১০ মার্চ৷ জার্মানির কোলন শহরে আশ্রয় নেয়া ওলেনা বললেন, ‘‘আমি এসেছি দনেৎস্ক অঞ্চল থেকে৷ আমার শহরের নাম আভদিভকা৷ ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আট মাস আমরা হামলার কবলে ছিলাম৷ এবং তারপর এলো ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২৷ হায় ঈশ্বর, কখনো ভাবিনি আবার যুদ্ধ শুরু হবে৷’’
ছবি: DW
‘ওখানে থাকলে কী যে হতো!’
ওলেনা জানান, ‘‘কিয়েভের যে গ্রামে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখানে কোনো রুশ সৈন্য ছিল না৷ কিন্তু খুব কাছের বুচা, মাকারিভ এবং বোরোদিয়ান্কায় ওরা ছিল৷ ওই জায়গাগুলোয় তুমুল বোমা আর গুলিবর্ষন চলছিল৷ তাই সিদ্ধান্ত নিলাম পালানোর, না পালালে কী যে হতো কে জানে, নিশ্চয়ই নিজের এবং বাচ্চাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তো৷’’
ছবি: DW
‘আমি চাই আমার সন্তানরা শান্তিতে বেড়ে উঠুক’
দু’দুবার যুদ্ধের কবলে পড়তে হয়েছে ওলেনাকে৷ তাই তার আপাতত একটাই চাওয়া- শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সন্তানদের বেড়ে উঠতে দেয়া৷ ইউক্রেনীয় এই নারী জানালেন, জার্মানিতে এখন ভালো আছেন তিনি, ‘‘এখানে আমি একটা অ্যাপার্টমেন্টে আছি৷ সব মিলিয়ে ভালোই আছি৷ আমার সন্তানরা স্কুলে যাচ্ছে, জার্মান শিখছে৷ আমিও এখন জার্মান শিখছি৷ দু‘দুবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে হয়েছে আমাদের৷ এখন আমি চাই আমার বাচ্চারা শান্তিতে বেড়ে উঠুক৷’’
ছবি: DW
‘মা, আমি কি এখন মারা যাবো?’
তাতিয়ানা ছিলেন খারকিভে৷ ৫ মার্চ শহর ছাড়ার আগের তিন সপ্তাহ প্রবল বোমাবর্ষনের মধ্যেই সেখানে থাকতে হয় তাকে৷ সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তাতিয়ানা বললেন, ‘‘ আমার দশ বছর বয়সি মেয়েটা ভয়ে সারাক্ষণ কাঁদতো আর জানতে চাইতো, মা, আমি কি এখন মরে যাবো? সেখান থেকে পালিয়ে আসার সময়ও খুব ভয় পেয়েছি৷ আমার মেয়ে আবার সেরকম ভয়াল সময়ে পড়েছে- এমন কথা আমি ভাতেও চাই না৷’’
ছবি: DW
‘হৃদয় পড়ে আছে খারকিভে’
জার্মানি ও ইউরোপের কিছু দেশ যুদ্ধের সময় ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোয় তাতিয়ানা খুব কৃতজ্ঞ৷ তবে জার্মানিতে নিরাপদ জীবন স্বস্তি দেয়নি তাকে, ‘‘এখানে আমি নিরাপদে আছি, কিন্তু মনটা পড়ে আছে খারকিভে৷ প্রতি সন্ধ্যায় আমি বোমা হামলার খবর, মানুষের মৃত্যুর খবর, আহত হওয়ার খবর পড়ি৷ তাই প্রতি সকালে দুশ্চিন্তা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের, বন্ধুদের ফোন করি৷ শুধু তারা ভালো আছেন- এই খবরটুকু জানার জন্য ফোন করি৷’’
ছবি: DW
কৃতজ্ঞ ইনা এবং জেনিয়া
ইনা আর তার বন্ধু জেনিয়া এসেছেন ওডেসা থেকে৷ তাদের সন্তানরা এখানে লেখাপড়া করছে৷ ইনা জানান, যুদ্ধের সময়ে জার্মানি তাদের জন্য্য যা করেছে তাতে তারা খুব কৃতজ্ঞ৷
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর অন্তত ২৮৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে৷ তবে এই পরিসংখ্যান পুরোপুরি চূড়ান্ত নয়৷ কেননা, এখনো অনেক অঞ্চল থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি৷
ইউরোপের দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, পূর্ব ইউক্রেনের একাধিক শহর থেকে শত শত মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে৷ তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক ছিল৷
আরকেসি/এআই (এএফপি, এপি, রয়টার্স)
যে পাঁচ উপায়ে পৃথিবী বদলে দিয়েছে যুদ্ধ
রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলা শুরুর ১০০ দিন পার হলো৷ অন্য রাষ্ট্রের সীমানায় ঢুকে এমন আক্রমণ গেল ৮০ বছরে ইউরোপে আর হয়নি৷ এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে৷ সেটি কেমন? চলুন দেখে নিই৷
ছবি: South Korean Defense Ministry/Getty Images
অসংখ্য শরণার্থী
রাশিয়ার আক্রমণের পর প্রায় ৬৮ লাখ ইউক্রেনিয়ান দেশ ছেড়েছেন৷ জাতিসংঘের হিসেবে, এদের প্রায় ৩০ লাখ প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশেও আশ্রয় নিয়েছেন৷ জার্মানিতে সাত লাখেরও বেশি ইউক্রেনিয়ান আশ্রয় নিয়েছেন৷ আরো ৭৭ লাখ দেশের ভেতরেই ঘরছাড়া হয়েছেন৷
ছবি: Kirsty O'Connor/empics/picture alliance
খাদ্য সংকট
বিশ্বের অর্ধেক সানফ্লাওয়ার ভোজ্য তেল উৎপাদন করে ইউক্রেন৷ এছাড়া দেশটি ১৫% ভুট্টা ও ১০% গম রপ্তানি করে৷ যুদ্ধের কারণে এসব পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে৷ এ কারণে এসব পণ্য উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোও অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রপ্তানি বন্ধ করেছে৷ গেল মে মাস পর্যন্ত ২৩টি দেশ এসব পণ্য রপ্তানি বন্ধ করেছে৷
ছবি: Jelena Djukic Pejic/DW
জ্বালানি সংকট
রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্বালানি গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ৷ তারা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও তৃতীয় সর্বোচ্চ কয়লা রপ্তানিকারক৷ ইউক্রেনে হামলা করার পর রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নির্ভরতা কমাতে বা বন্ধ করতে একযোগে কাজ করছে ইউরোপের দেশগুলো৷ রাশিয়াও একাধিক ইউরোপীয় দেশে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে৷
ছবি: ITAR-TASS/imago
দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি
খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি সংকটের মুখে দাম বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের৷ বেড়েছে মার্কিন ডলারের দাম৷ ইউরোজোনে গত মাসে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে ৮.১%৷ সারা বিশ্বেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে৷
ছবি: Emre Eser/DW
ন্যাটোর পুনর্জন্ম
রাশিয়ার আক্রমণ এককাট্টা করেছে ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোকে৷ শুধু তাই নয়, রাশিয়ার কারণে নিরাপত্তা হুমকিতে ভোগা অনেক রাষ্ট্র এখন ৩০ সদস্যদেশের এই জোটে যুক্ত হবার ব্যাপারে ভাবছে৷ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন এরই মধ্যে তাদের আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দিয়েছে৷