বিমান বাহিনীর জন্য মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে জার্মানি৷ রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা আগেই দিয়েছিল বার্লিন৷
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন সংবাদসংস্থায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে গোপন সূত্রের বরাত দিয়ে সোমবার এ তথ্য জানানো হয়েছে৷
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জার্মানি নিজেদের পুরাতন হয়ে যাওয়া টর্নেডো বিমান বহরকে আধুনিকায়ন করতে চায়৷ এই লক্ষ্যেই লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷
ইউক্রেন সংঘাতের ফলে নিজেদের বৈদেশিক ও প্রতিরক্ষা নীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছে বার্লিন৷ চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস জার্মানির প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় ব্যাপক মাত্রায় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
জার্মানিরযুদ্ধবিমানপ্রয়োজনকেন?
রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে, ন্যাটোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জার্মানির প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে জিডিপির দুই শতাংশে নিয়ে আসার ঘোষণা দেন শলৎস৷ তিনি বলেন, জার্মান সেনাবাহিনী বিনিয়োগ এবং অস্ত্র খাতে ১০০ বিলিয়ন ইউরো পাবে৷
জার্মান সেনাবাহিনীর যত কেলেঙ্কারি
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতে, ২০১৭ সাল ভয়ঙ্কর, বিভৎস, ভয়াবহ এবং খারাপ বছর৷ নিজের সেনাবাহিনীকে সমর্থন না করে বরং তাদের কেলেঙ্কারি তুলে ধরে ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তিনি৷ জেনে নিন জার্মান সেনাবাহিনীর কেলেঙ্কারির কথা৷
ছবি: picture alliance/akg-images
এক ভুয়া শরণার্থী
সিরীয় শরণার্থী সেজে এক জার্মান সেনা কর্মকর্তা সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল৷ সমান্তরাল এক দ্বিতীয় জীবন শুরু করেছিলেন ফ্রাংকো৷ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরীয় শরণার্থী হিসেবে নথিভুক্ত হন তিনি৷ তার লক্ষ্য ছিল শরণার্থীদের উপর হামলার দোষ চাপানো৷ ২০১৪ সাল থেকেই ফ্রাংকো’র ডানপন্থি আচরণের কথা জানতেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা৷ এাই ফ্রাংকো ধরা পড়ার থেকে জার্মান সেনাবাহিনিকে শুরু হয় বিতর্ক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorst
বাড রাইশেনহাল পর্বতে রেঞ্জার ইউনিটে হয়রানি
ডানপন্থি সন্ত্রাসী আচরণের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য সেনাবাহিনী বর্তমানে ২৭৫ টি মামলার তদন্ত করছে৷ চলতি বছরের মার্চে জনগণ একজন ল্যান্স করপোরালের কথা জানতে পারেন, যিনি কয়েক মাস ধরে বাভেরিয়া পর্বতের রেঞ্জার ইউনিটে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতিত ব্যক্তি জানিয়েছেন, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে যৌন নীপিড়ন করা হয়েছে৷ এ ঘটনার জন্য ১৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
নারীদের পোল ড্যান্সে বাধ্য করা
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সবচেয়ে বড় যে কেলেঙ্কারির কথা বলেছেন তাহলো, ফুলেনডর্ফে স্টাওফের সেনাঘাঁটির ভয়াবহ ঘটনা৷ জানুয়ারিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের নগ্ন করা ও যৌনতা প্রকাশ পায় এমন আচরণ করতে বাধ্য করেছিলেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, সেগুলো ভিডিও করা হয়েছিল৷ সদ্য নিয়োগ পাওয়া নারীদের ‘এনট্র্যান্স পরীক্ষা’র অংশ হিসেবে পোল ড্যান্সে বাধ্য করা হয়েছিল৷ একারণে সেনাবাহিনীর শীর্ষ প্রশিক্ষক কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Warnack
ডানপন্থি সন্ত্রাসবাদের অনেক ঘটনার তদন্ত চলছে
জার্মান সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি কমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সাল জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য মোটেই ভালো বছর ছিল না৷ ডানপন্থি সন্ত্রাসবাদ বা ‘জার্মানির মুক্ত গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক চেতনার লঙ্ঘন’ এর মোট ৬০টি অভিযোগের ঘটনা পাওয়া গেছে৷ এমনকি সেনারা নিজেদের নাৎসি চেতনা নিয়ে একে অপরের সাথে আলোচনা করে, নাৎসি সংগীত শোনে ও নাৎসি স্যালুটও দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Sauer
জাহাজে মৃত্যু
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে কোনো মাথা ঘামায়নি সেনাবাহিনী৷ ২০১০ সালের একটি ঘটনা জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তা হলো, গর্ক ফক-এ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় ২৫ বছরের এক সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা৷ প্রশিক্ষণের সময় ঐ নারী জাহাজের পাল থেকে নীচে পড়ে মারা যান৷ ফলে অন্যান্য ক্যাডেটরা পালে উঠতে আর রাজি হননি৷ পরে ঐ প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Rehder
জার্মান সেনাবাহিনীর জন্ম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে ছিল না৷ পশ্চিম জার্মানিতে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে৷ পুনরেকত্রীকরণের পর পূর্ব জামানির সেনাবাহিনী থেকে ২০ হাজার সদস্য নেয় কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী৷ ১৯৯৯ সালে যখন জার্মান সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক সংঘাতে (কসোভো যুদ্ধ) জড়িয়ে পড়ে, তখন এতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়৷ এর আগ পর্যন্ত কেবল বিদেশে শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল৷
ছবি: picture alliance/akg-images
বাধ্যতামূলক সেবা নয়
বর্তমানে জার্মান সেনাবাহিনীতে সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার ২০০৷ ২০১৭ সালের মার্চের হিসেব অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর মোট সদস্যের ১১.৪ শতাংশ নারী৷ ২০১১ সাল পর্যন্ত জার্মান সেনাবাহিনীতে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল৷ এই মেয়াদকাল ছিল ৯ থেকে ১৮ মাস৷ বর্তমানে তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়৷ তবে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির কারণে এই আবেদনে তাদের সাড়া দেয়াটা সত্যিই কঠিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Sauer
7 ছবি1 | 7
এফ-৩৫ কে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক যুদ্ধবিমান মনে করা হয়৷ এর অভিনব আকার এবং বাইরের আবরণের কারণে শত্রু রাডারে একে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়৷
বর্তমানে টর্নেডোই একমাত্র জার্মান বিমান যা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মার্কিন পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম৷ কিন্তু এই টর্নেডো ফ্লিটের বয়স ৪০ বছরেরও বেশি৷ জার্মান বিমান বাহিনী এই বিমানগুলো সেই ১৯৮০ সাল থেকে পরিচালনা করে আসছে৷ বিমানগুলোর মেয়াদ ২০২৫ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে৷
৩৫টি এমন বিমান কেনার পরিকল্পনার তথ্যও জানানো হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে৷
তবে এর ফলে ফ্রান্সের সঙ্গে ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান তৈরির যৌথ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
এফ-৩৫ কেনার সিদ্ধান্ত বোয়িং এর জন্য একটি বড় ধাক্কা৷ টর্নেডো বহরের বিকল্প হিসাবে বোয়িংয়ের এফ-১৮ ছিল সাবেক জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাওয়ারের পছন্দ৷
জার্মানির ন্যাটো মিশন
ন্যাটোতে পশ্চিম জার্মানির অন্তর্ভূক্তির পর থেকে ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছে বার্লিন৷ আর ১৯৯০ সাল থেকে জার্মানির সেনাবাহিনী বুন্ডেসভেয়ার নিজেদের ‘আওতাভুক্ত নয়’, এমন জায়গায়ও কাজ করেছে৷
ছবি: S. Gallup/Getty Images
ন্যাটোতে জার্মানির ভূমিকা
তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি ১৯৫৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোতে যোগ দেয়৷ তবে, দুই জার্মানির পুর্নমিলনের আগ অবধি নিজেদের ‘আওতাভুক্ত নয়’ এমন এলাকাতে ন্যাটোর নেতৃত্বে মিশনে যায়নি জার্মানি৷ ১৯৯০ সালের পর থেকে বিশ্বের নানাপ্রান্তে শান্তিরক্ষা থেকে প্রতিরক্ষা অবধি নানা পর্যায়ে ন্যাটোর মিশনে অংশ নিয়েছে দেশটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hanschke
বসনিয়া: জার্মানির প্রথম ন্যাটো মিশন
জার্মানি ১৯৯৫ সালে প্রথম ‘নিজেদের আওতাভুক্ত নয়’ এমন এলাকায় ন্যাটোর নেতৃত্বে শান্তি রক্ষায় সেনা মোতায়েন করে৷ দেশটির নাম বসনিয়া হ্যারৎসেগোভিনা৷ বসনিয়া যুদ্ধের সময় সেখানে নিরাপত্তা প্রদানে ভূমিকা পালন করে জার্মান সেনারা৷ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর ষাট হাজারের বেশি সেনা সেসময় বসনিয়ায় মোতায়েন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/H. Delic
কসভোয় শান্তি রক্ষা
কসভোতে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন শান্তিরক্ষা মিশনের শুরু থেকে সাড়ে আট হাজারের মতো জার্মান সেনা সেখানে মোতায়েন করা হয়৷ ১৯৯৯ সালে ন্যাটো সার্বিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর উপর বিমান হামলাও চালিয়েছিল, কেননা, সেই সময় তারা সংখ্যালঘু আলবেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের বেসামরিক সমর্থকদের উপর দমনপীড়ন চালাচ্ছিল৷ এখনও সাড়ে পাঁচশ’র মতো বুন্ডেসভেয়ারের সেনা দেশটিতে মোতায়েন রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V.Xhemaj
এজিয়ান সি-তে টহল
জার্মানি ২০১৬ সালে কমব্যাট সাপোর্ট শিপ ‘বন’-কে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থিত ন্যাটো মিশনের আওয়তায় এজিয়ান সি-তে মোতায়েন করে৷ অভিবাসী সংকটের সময় গ্রিক এবং তুর্কি সমুদ্রসীমায় অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ছিল এই মিশনের অংশ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/M.Schreiber
এক দশকের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে
জার্মান সংসদ ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে মোতায়েন ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে সেনা পাঠানোর পক্ষে মত দেয়৷ ফলে জার্মানি ন্যাটো বাহিনীতে তৃতীয় বৃহত্তম সেনা পাঠানো দেশে পরিনত হয়৷ এই মিশনে পঞ্চাশ জনের বেশি জার্মান নিহত হয়েছে৷ এখনো প্রায় হাজারখানেকের মতো সেনা সেদেশে মোতায়েন রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/A.Niedringhaus
লিথুয়ানিয়ায় জার্মান ট্যাংক
বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে ন্যাটোর উপস্থিতি বাড়ানোর অংশ হিসেবে বুন্ডেসভেয়ারের সাড়ে চারশ’ সেনা ২০১৭ সালে লিথুয়ানিয়ায় মোতায়েন করা হয়েছে৷ ন্যাটোর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই উপস্থিতিকে শক্তিশালী করছে জার্মানির সর্বাধুনিক ট্যাংক৷ তাছাড়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তত বাহিনীর নেতৃত্বেও রয়েছে জার্মানি, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র৷
ছবি: picture alliance/dpa/M. Kul
নেতৃত্ব গ্রহণ
২০১৯ সালে ন্যাটোর বহুজাতিক ‘ভেরি হাই রেডিনেস জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স (ভিজেটিএফ)’-এর নেতৃত্ব দেবে জার্মানি৷ জোটটির পূর্বাংশে রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের জবাব দিতে এই ব়্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স তৈরি করা হয়েছে৷