মার্কিন নির্বাচনেও জিতলে 'জনগণের রায়', হারলে 'কারচুপি'!
৬ নভেম্বর ২০২০ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারা ছাড়া তিনি আর যা যা করছেন, তার সবই আমাদের অনেকদিনের চেনাজানা৷
এরই মধ্যে নানা রাজ্যে নির্বাচন বর্জন করে ট্রাম্পের সমর্থকদের রাস্তায় বিক্ষোভ করার খবর পাওয়া গেছে৷ এমনকি ফিলাডেলফিয়ায় বোট গণনা কেন্দ্রে সম্ভাব্য হামলা নিয়ে তদন্ত করার কথাও জানিয়েছে পুলিশ৷ বাংলাদেশের নেতাদের মুখে প্রায়ই ‘বাংলাদেশ অ্যামেরিকা হয়ে গেছে' ধরনের মন্তব্য শোনা যায়৷ গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা, ক্ষমতার লোভ, ইত্যাদির ফলে এখন অ্যামেরিকার অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বরং ‘অ্যামেরিকা বাংলাদেশ হয়ে গেছে' বলাটাই সময়ের ব্যাপার৷
২০১৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতারাই তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছিলেন না ডনাল্ড ট্রাম্পকে৷ কিন্তু ভিত্তিহীন কথাবার্তা, উগ্রতা, বিদ্বেষমূলক আচরণ সত্ত্বেও দুর্দণ্ড প্রতাপে অন্য সবাইকে পেছনে ফেলে তিনিই নির্বাচিত হন রিপাবলিকান প্রার্থী৷ এমনকি ডেমোক্র্যাট হিলারিকে হারিয়ে সহজেই জিতে নেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদও৷
প্রায় পাঁচ বছরের এই যাত্রায় যেসব প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্র নামক ধারণাকে টিকিয়ে রাখে, তার সবকটিকেই ছুঁড়ে ফেলেছেন ট্রাম্প৷ বর্ণবাদী আচরণ, নারীদের প্রতি বিদ্বেষ, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ, বিশ্বের বিভিন্ন নেতাকে নিয়ে হুটহাট বাজে মন্তব্য ইত্যাদি নানা কিছুর মাধ্যমে ট্রাম্পের শাসনামলে বিশ্বজুড়ে তথাকথিত নেতৃত্ব হারিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷
কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনের কথা যদি আমাদের মনে থাকে তাহলে এটাও মনে থাকার কথা, ট্রাম্পের জয়ের পরপরই সে জয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা চেষ্টা গত চার বছর ধরে চালিয়ে গেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ডেমোক্র্য়াটদের দখলে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ মার্কিন নির্বাচনে ‘রুশ হস্তক্ষেপ' বিষয়টিকে এমনভাবে সামনে তুলে আনা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে যে ট্রাম্পকে মার্কিন জনগণ ভোট দেয়নি বরং রাশিয়াই কারচুপি করে ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিয়েছে৷
এ বিষয়ক তদন্তে নিয়মিত বাধার সৃষ্টি করে ট্রাম্প এই সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলেছেন৷ কিন্তু পাশাপাশি এটিও সত্য, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ালেও নিজের দেশের নির্বাচনে এত বড় কারচুপির অভিযোগে তদন্তে কোনো সন্দেহাতীত প্রমাণ হাজির করতে পারেনি মার্কিন গোয়েন্দারা৷ তারপরও থেমে থাকেনি মার্কিন গণমাধ্যম৷ এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পকে অভিশংসন করার চেষ্টা অনেকটা গায়ের জোরের মতোই দেখিয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত সেটা না পেরে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যেভাবে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিলেন, তাতে জনগণের মত বা গণতন্ত্রের প্রতি আসলেই মার্কিন নেতাদের কতটুকু শ্রদ্ধা রয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন জাগেই৷
২০১৬ সালের নির্বাচনে ‘জনগণ রায় দিয়েছে' দাবি করলেও ২০২০ সালে ট্রাম্প চলে গেলেন অন্য পক্ষে৷ এবার হেরে যাওয়ান সম্ভাবনা দেখে নিজেই দাবি করা শুরু করলেন ‘আমি জিতেছি, কিন্তু ভোট চুরি করে আমাদের হারিয়ে দেয়া হচ্ছে৷'
নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের টুইট শুরু হয় ৩ নভেম্বর ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৩টা ৩৭ মিনিটে৷ নিজের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরে মার্কিন জনগণকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান তিনি৷ ৬ নভেম্বর স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৫ পর্যন্ত ৩১টি টুইট করেছেন তিনি৷ কোনোটায় দাবি করেছেন তিনি জিতে গেছেন, কিন্তু ভোট চুরি করে হারিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ আবার পোস্টাল ব্যালট নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভোট গণনা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন৷ এমনকি শেষ টুইটে সতর্কতামূলক বার্তা যুক্ত করে দেয়ায় টুইটারকেই আক্রমণ করে বসেছেন৷
তবে যে টুইটটিতে এক কথায় নিজের ভাব প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প সেটি হচ্ছে এমন- ‘‘বৈধ ভোটে আমি সহজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছি৷ পর্যবেক্ষকদের কাজ করতে দেয়া হয়নি, ফলে এই সময়ে গ্রহণ করা সব ভোট অবৈধ বলে বিবেচনা করা উচিত৷ মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এ নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে৷''
দ্বিধান্বিত হওয়ার কারণ নেই৷ অনেকে নিজের দেশের নির্বাচনের সঙ্গে মিল খুঁজে পেলেও এখানে আসলে মার্কিন নির্বাচনের কথাই বলা হচ্ছে৷ ভোটের ওপর আস্থা হারিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আস্থা স্থাপনেরও যথেষ্ট করাণ রয়েছে৷ কদিন আগেই রীতি ভেঙে নিজের পছন্দমতো এক বিচারক নিয়োগ করে নয় সদস্যের সুপ্রিম কোর্টে ছয় জন রিপাবলিকান বিচারপতি নিশ্চিত করেছেন তিনি৷ ফলে ট্রাম্পের আশা, সেই বিচারপতিরা আইনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিবেচনা না করে দলীয় দৃষ্টিতে রায় দিয়ে ট্রাম্পকেই জিতিয়ে দেবেন৷
এরই মধ্যে কংগ্রেস, গোয়েন্দা সংস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা, সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেটিকে বিতর্কিত করেছেন ট্রাম্প৷ তার বিরোধীতা করতে গিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও হেঁটেছেন একই পথে৷ নিজে নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরো মার্কিন গণতন্ত্রকেই টেনে নামাতে চেয়েছেন ট্রাম্প৷
মুক্ত বিশ্বের তথাকথিত নেতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের যে অবস্থান ছিল, তা এখন আর নেই৷ বাইডেন সে স্থান পুনরুদ্ধার করতে পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়৷ তবে ট্রাম্প অধ্যায়ের হয়তো শিগগিরই অবসান ঘটছে না৷ এরই মধ্য়ে আইনি লড়াই শুরু করেছেন তিনি৷ এ লড়াই দীর্ঘদিন চলবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে৷ পাশাপাশি এখনই ২০২৪ সালের নির্বাচনে লড়াইয়ের আবার ট্রাম্পের অংশ নেয়ার আভাসও দিচ্ছেন তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচর৷
তবে এটি সত্য, ইউনাইটেড স্টেটস অব অ্যামেরিকাকে সফলভাবে ডিভাইডেড স্টেটস অব অ্যামেরিকাতে পরিণত করেছেন ট্রাম্প৷ দাসপ্রথা থাকবে কি থাকবে না, এ নিয়ে মার্কিন রাজ্যগুলি গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছিল ১৮৬১-১৮৬৫ সালে৷ পরবর্তী ১৬০ বছরে মার্কিন সমাজ আর কখনও এতটা বিভক্ত হয়নি৷
অবশ্য ক্ষমতায় থেকেও শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প নিজের পক্ষে নির্বাচনের ফল আনতে পারলেন না৷ এটাতেই হয়তো মার্কিন গণতন্ত্রের বাতি টিমটিম করে জ্বলতে থাকবে৷
শুরুতে ভাবছিলাম, ট্রাম্পের পরাজয়ের মাধ্যমে উগ্র ডানপন্থি পপুলিজমের পতনের বার্তা ছড়াবে বিশ্বজুড়ে৷ কিন্তু ট্রাম্প যে বিশাল পরিমাণ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বার জয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তেই চলে গিয়েছিলেন, তাতে বলতে বাধ্য হচ্ছি- পপুলিজমের পতন ঘটেছে নিশ্চিতহয়ে বলার সময় এখনও আসেনি৷ ট্রাম্প হয়তো হেরে গেছেন, ট্রাম্পের কোটি কোটি সমর্থকরা কিন্তু সংখ্যায় বেড়ে চলেছেন, গণতন্ত্রের এটিই বড় এক বিপদ৷ কিন্তু গণতন্ত্র মানতে হলে এই বিপদের আশঙ্কাও মেনে নিতে হয় আমাদের, সেটি আরো বড় বিপদ৷