র্যাব- পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রায় চার মাস পর বাংলাদেশে আবার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
বিজ্ঞাপন
গত শনিবার রাতে কুমিল্লার সদর আদর্শ উপজেলার গোলাবাড়ি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' রাজু নামে একজন নিহত হন৷ তিনি সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম হত্যার আসামি৷
কুমিল্লার সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারকে গত ১৩ এপ্রিল(বুধবার) রাত ১০টার দিকে ডেকে নিয়ে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত এলাকায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে৷ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ১৪ এপ্রিল( বৃহস্পতিবার) রাতে এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে৷ আরেকজন এজাহারভুক্ত আসামি রাজু র্যাবের সঙ্গে শনিবার রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন৷ রাত দুইটার দিকে ওই ঘটনা ঘটে৷
র্যাব ১১-এর কুমিল্লা ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, ‘‘আমরা সাংবাদিক হত্যার আসামি ধরতে কোনো অভিযান চালাইনি৷ সে রাজু কি না তাও আমরা জানতাম না৷ আমাদের কাছে খবর ছিলো গোলাবাড়ি এলাকায় একদল সন্ত্রাসী নাশকতা করার জন্য আত্মগোপন করে আছে৷ এই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের টহল টিম সেখানে পৌঁছালে তারা আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে৷ আমরাও আত্মরক্ষার্থে গুলি করি৷ গোলাগুলি শেষ হলে আমাদের এক সদস্যকে আহত দেখতে পাই৷ চার-পাঁচজন লোক পালিয়ে যায়৷ এলাকার লোকজন এসে পড়ে৷ আমাদের সদস্যকে উদ্ধার করার পর আশপাশে খোঁজাখুঁজি করে দেখি গুলিতে আহত একজন অজ্ঞাত যুবক পড়ে আছে৷ তার পাশে একটি লোডেড পিস্তল৷ তাকে উদ্ধার করে আমরা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই৷ আমরা জীবিত অবস্থায়ই হাসপাতালে পাঠাই তাকে৷''
নূর খান
This browser does not support the audio element.
তিনি বলেন, ‘‘পিস্তল ছাড়াও তার কাছে কয়েকটি ইয়াবা, দেড় বোতল ফেনসিডিল এগুলো পাওয়া যায়৷ মাদক বলতে যা বুঝায় সেরকম কিছু না৷ আমাদের কাছে সেরকম তথ্যও ছিলো না৷ আমরা জানতাম অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ওইখানে আছে৷''
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. দুলাল বলেন, ‘‘হাসপাতালে আনার পর পরই তাকে ডেড ডিক্লেয়ার করা হয়৷ হাসপাতালের খাতায় তাই লেখা আছে৷''
গত ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এই প্রথম বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল৷ তবে ওই নিষেধাজ্ঞার কয়েক ঘণ্টা আগেও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ ১০ সিসেম্বরের আগের পাঁচদিনে ক্রসফায়ারে পাঁচজন নিহত হয়েছে৷
এর আগেও ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে পুলিশের হাতে ক্রসফায়ারের নামে মেজর(অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর কিছুদিন ক্রসফায়ার বন্ধ ছিলো৷
ড. জিয়া রহমান
This browser does not support the audio element.
আর ২০১৮ সালের ২৬ মে কক্সবাজারের টেকনাফের ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হককে বন্দুক যুদ্ধের নামে হত্যার ঘটনার পর একটি অডিও প্রকাশ হওয়ায় ক্রসফায়ার নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ তখনো কিছুদিন ক্রসফায়ার বন্ধ ছিলো৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮০টি৷ ২০২০ সালে ২২২ জন এবং ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন নিহত হন৷ তাদের হিসবে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷
আসকের তথ্যমতে শনিবারের ক্রসফায়ারের ঘটনার আগে চলতি বছরে বাংলাদেশে আর কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি৷ তবে পুলিশ ও র্যাব হেফাজতে চারজন মারা গেছেন৷
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনাগুলো ঘটেনি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
দুই দশক
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫-০৬ সালে৷ ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তবে আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে দুই দশকে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজারের বেশি৷
ছবি: Shahidul Alam/Drik/Majority World
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
সেসময় ক্রসফায়ার নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের৷ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুচ্ছেদে ৫.২ নং অঙ্গীকারে বলা হয়েছিল, ‘‘বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
কথা রাখেনি সরকার
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মারা গেছেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ৷ (২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবি)
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. Nath
নির্বাচন ও ক্রসফায়ার
আসক এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নির্বাচনী বছর ও তার আগের বছরে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন বা মোট ৩২৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ৪৬৬ টি ঘটনা ঘটে যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি৷ ২০১৯ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৮৮ টি৷
ছবি: DW/A. Islam
২০২১ সাল নিম্নমুখী
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২টি৷ সেখানে গত বছর এমন ঘটনা ঘটেছে মোট ৮০টি৷ এর মধ্যে ৩০টির সঙ্গে জড়িত র্যাব, ২৪টিতে পুলিশ, দুইটিতে র্যাব ও পুলিশ এবং ১৭টি ঘটনায় বিজিবির নাম এসেছে৷ ৪৮টি ক্ষেত্রেই গেপ্তারের আগে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: Getty Images
নানা নাম
তবে এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বন্দুকযুদ্ধ কখনওবা এনকাউন্টার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়া হয় বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে৷ সম্প্রতি র্যাব দাবি করেছে তাদের সদস্যদের সঙ্গে ‘ধস্তাধস্তিতে’ গাজীপুরে এক ব্যক্তি মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
একরামুল হত্যা
২০১৮ সালে ২৬ শে মে র্যাবের ‘মাদক বিরোধী অভিযানে’ কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর র্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনায় একরামুলের পরিবার মামলা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/S. Kumar Dey
মেজর সিনহা হত্যা
বাংলাদেশে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা৷ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন৷ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো শতাধিক এমন হত্যার অভিযোগও রয়েছে৷
ছবি: bdnews24
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগের পাঁচদিনে ‘ক্রসফয়ারে’ পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এরপর আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷
ছবি: DW
সরকারের বক্তব্য
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু হয় না বলে বারবারই দাবি করে আসা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও সরকার এই কথা জোর দিয়ে বলে আসছে৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে৷’’
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
আসকের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আমরা অতীতেও দেখেছি কোন চাপ বা মানুষের ক্ষোভের পর কিছুদিন ক্রসফায়ার বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়৷ এবারও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর আমরা সেই আশঙ্কা করেছিলাম৷ শনিবারের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের আশঙ্কা সঠিক প্রমাণ হলো৷
‘‘রাষ্ট্র ও সরকার যতদিন পর্যন্ত এইসব ঘটনার স্বাধীন তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় না আনবে ততদিন এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না৷ রাষ্ট্র যদি এটাকে কৌশল হিসেব নেয় তাহলে তো বন্ধ হবে না৷''
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘‘যতদিন পর্যন্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হবে, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম যতদিন পর্যন্ত উন্নত করা না যাবে, এই কলোনিয়াল পুলিশ কোর্ট ও প্রসিকিউশন যত দিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই অবস্থার উন্নতি হবে না৷ এ জাতীয় বিষয়ের সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘কে নিষেধাজ্ঞা দিলো৷ তার দেশের অবস্থা কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের স্বার্থেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে৷ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷''