সম্প্রতি মালদ্বীপের কিছু মন্ত্রী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা এক কথায় কুৎসিত। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, তা-ও রুচিপূর্ণ নয়।
বিজ্ঞাপন
মাসকয়েক আগেই ভারতের সঙ্গে ক্যানাডার কূটনৈতিক বিতর্ক দেখেছি আমরা। সেই বিতর্ক এখনো অব্যাহত। ভারত এবং ক্যানাডা দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড়। ফলে মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্য যত গড়িয়েছে, বিতর্কও তত তীব্র হয়েছে।
এখানেই ক্যানাডা বিতর্কের সঙ্গে মালদ্বীপবিতর্কের তফাত। বস্তুত, বিভিন্ন দিক থেকেই মালদ্বীপ রাষ্ট্রটি ভারতের উপর নির্ভরশীল। তবে সম্প্রতি কূটনীতিকেরা বলছেন, আরো অনেক প্রতিবেশীর মতো মালদ্বীপও ভারত থেকে খানিকটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের সেনা বাহিনী মালদ্বীপে থাকবে কি না, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন আগেই বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী। সেই বিতর্ক খুব বেশি দূর গড়ায়নি।
পানিতে বসবাস
পানিতে বসবাস - সেও কি সম্ভব! অবশ্যই, বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই রয়েছে নৌকায় বাস করা মানুষের উপস্থিতি৷ বিশ্বের আরো অনেক অঞ্চলে এই ধারণা এখন ছড়িয়ে পড়ছে৷ বিস্তারিত এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images
বানের পানিতে ভাসবে
বাড়ন্ত সমুদ্রের মাঝেই জীবন যাপন: ডাচ নির্মাণ কৌশল বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওয়াটার স্টুডিও ডট এনএল পানিতে ভাসমান অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স তৈরি করেছে৷ ডেলফ্ট এবং হেগের মধ্যে তৈরি এই কমপ্লেক্সে ৬০টি অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে৷ ওয়াটার স্টুডিও ডট এনএল পানির উপরে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী৷ তাছাড়া এটাতো অনেকই জানেন, নেদারল্যান্ডসের এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডই সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে নিচের দিকে অবস্থিত৷
ছবি: Koen Olthuis, Waterstudio.NL / ONW/BNG GO
মানবকুলের প্রবেশ নিষেধ
‘সমুদ্র বৃক্ষ’ ধারণার অংশ হিসেবে ভাসমান এই স্থাপনাটি তৈরি করেছে ওয়াটার স্টুডিও ডট এনএল৷ এটির বিভিন্ন লেয়ারে আলাদা আলাদাভাবে নানা প্রজাতির পাখি বসবাস করতে পারবে৷ তবে মানবকুলের সেখানে যাওয়া বারণ৷
ছবি: Koen Olthuis, Waterstudio.NL
ভাসমান মসজিদ
নেদারল্যান্ডসই বিশ্বের একমাত্র দেশ নয়, যারা সমৃদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত৷ তাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য এই ভাসমান মসজিদটি তৈরি করেছেন ডাচ স্থপতিরা৷ মসজিদের উপরের কলামগুলো শুধু ভারসাম্যই রক্ষা করছে না, একই সঙ্গে মসজিদের ভেতরের দিকে আলোর যোগানও দিচ্ছে৷
ছবি: Koen Olthuis, Waterstudio.NL
উচ্চ প্রযুক্তির অবকাশ নন্দনকানন
সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে মালদ্বীপ৷ অনেক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই দ্বীপদেশটি পুরোটাই একসময় সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে৷ তবে পর্যটকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই৷ ডাচ স্থপতিরা তৈরি করেছেন এই কৃত্রিম ‘গ্রিন স্টার’ দ্বীপ, যেখানে দ্বীপে অবকাশ যাপনের পুরো স্বাদই মিলবে৷
ছবি: Koen Olthuis, Waterstudio.NL
ফুলের শক্তি
মালদ্বীপের জন্য বড় ধরনের ফুলের এই স্থাপনাটি তৈরি করেছে ওয়াটার স্টুডিও ডট এনএল৷ এটির মধ্যে ১৮৫টি অভিজাত ভিলা রয়েছে৷ পাঁচটি ইতোমধ্যে বিক্রির জন্য প্রস্তুত৷
সমুদ্রে ভাসমান একটি ভিলার ছবি এটি৷ মালদ্বীপের মূল ভূখণ্ডের খুব কাছেই এগুলোর অবস্থান৷ পরিকল্পিত স্থাপনাটিতে দোকান, রেস্তোরাঁ এবং হোটেলও রয়েছে৷ অবশ্য মালদ্বীপের জন্য এগুলো অভিজাত কিছু নয়৷ বরং ভবিষ্যতে এরকম কাঠামো তাদের প্রয়োজন হবে টিকে থাকতে৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে ২,০০০ দ্বীপ তলিয়ে যেতে পারে৷
পানিতে বসবাসের এই ধারণা অবশ্য নতুন কিছু নয়৷ কৃত্রিম দ্বীপের ধারণা বহু আগে থেকেই ভবিষ্যত পরিকল্পনার টেবিলে ছিল৷ তাছাড়া অনেক মানুষ আগে থেকেই পানিতে থাকছে৷ নেদারল্যান্ডসে নৌকাবাড়িতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়৷ সেদেশে নৌকাবাড়ির সংখ্যা ১০,০০০ হাজারের মতো, এগুলোর মধ্যে আড়াই হাজারের অবস্থান বিভিন্ন খালের মধ্যে৷
ছবি: Fotolia/peteri
ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য
পৃথিবীর অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চলের অনেক মানুষ বহু আগে থেকেই নৌকায় বাস করছে৷ কাশ্মীরে ২৫ বাই ৪০ মিটার আকারের এই নৌকাটি পর্যটকদের ভাড়া দেওয়া হয়৷ একজন ইংরেজ শত বছর আগে নৌকায় বসবাসের ধারণা নিয়ে এগিয়েছিল, যখন তাঁকে জমি কিনতে দেওয়া হয়নি৷ ভবিষ্যতে ভারত, বাংলাদেশে নৌকায় বসবাসের হার বেড়ে যেতে পারে৷ কেননা, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ক্ষতির মুখে রয়েছে এই দেশদুটোও৷
ছবি: Getty Images
হা লং বে’তে ভাসমান গ্রাম
ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হা লং বে এলাকায় গেলে চোখে পড়বে এমন দৃশ্য৷ সেখানে ১,৬০০ মানুষ কাঠের তৈরি নৌকাবাড়িতে বসবাস করছে৷ হা লং বে’র অধিবাসীদের মূল আয়ের উৎস হচ্ছে মাছ ধরা, মুক্তা সংগ্রহ আর পর্যটন৷ এসব নৌকাবাড়ির বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় ডিজেল ইঞ্জিন৷
ছবি: Fotolia/MasterLu
বিক্রির তালিকায় ইউরোপ
আরব উপদ্বীপ আরো বড় পর্যায়ে পানিতে বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে৷ দুবাইয়ে এরকম এক স্থাপনার নাম হচ্ছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’৷ সেখানে ২৭০টি দ্বীপকে পাঁচটি মহাদেশের আদলে সাজানো হয়েছে৷ এসব মহাদেশে সম্পত্তি কিনতে খরচ পড়বে ১১ থেকে ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার পর মালদ্বীপের অন্তত তিনজন মন্ত্রী তা নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করেন। কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অন্য দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত তার তীব্র নিন্দা করেছে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য, মালদ্বীপ একবার নয়, বার বার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তারা এধরনের মন্তব্য স্বীকার করে না। যাদের বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছিল, দ্রুত তাদের সকলকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এখানেই ক্যানাডা বিতর্কের সঙ্গে মালদ্বীপ বিতর্কের তফাত। মালদ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে কুরুচিকর মন্তব্য করা মন্ত্রীদের থেকে নিজের দূরত্ব তৈরি করে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা এই বিতর্ক শেষ করতে চাইছে। স্বয়ং মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হোক এমন কোনো কিছু তিনি হতে দেবেন না।
মালদ্বীপে অচলাবস্থা অব্যাহত
মালদ্বীপের অচলাবস্থা এখনো কাটেনি৷ একদিকে সরকারপক্ষ চরম অবস্থান গ্রহণ করেছে৷ অন্যদিকে বিরোধীরা রাস্তায় নেমে লাগাতার বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে৷ মালদ্বীপ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিও৷
ছবি: picture-alliance/M.Sharuhaan
উর্দির শাসন
বন্দিদের মুক্তির দাবিতে মালদ্বীপের রাস্তায় লাগাতার বিক্ষোভ চালাচ্ছেন বিরোধীরা৷ পুলিশও দ্রুত ঘিরে ফেলছে তাঁদের৷ বহু আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে৷ অন্যদিকে, দেশের জেলবন্দি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চাইছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলুক সরকার, বাতিল হোক জরুরি অবস্থা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo(M. Sharuhaan
সেনার টহল
আচমকা দেখলে মনে হবে যুদ্ধ লেগে গেছে৷ জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর মালদ্বীপের প্রতিটি রাস্তার দখল নিয়েছে সেনা৷ রণসাজে সজ্জিত হয়ে টহল চলছে সর্বত্র৷ রাজপথে পুলিশ এবং সেনা ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছে৷
ছবি: Reuters
প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা
এত কিছুর মধ্যে প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়েমিনের নিরাপত্তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ নিরাপত্তার বলয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে তাঁর বাড়ি ও অফিস৷ ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর প্রেসিডেন্ট জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণও দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/M.Sharuhaan
তীব্র লড়াই
পুলিশ এবং সেনা যতই দমন করার চেষ্টা করুক, বিরোধীদের আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে৷ তাদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, জেলবন্দিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ জারি থাকবে৷
ছবি: picture-alliance/M.Sharuhaan
নজরে বিরোধী সদর দফতর
বিরোধীরা যাতে রাস্তায় নামতে না পারে, তার জন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন৷ ইতিমধ্যেই ঘিরে ফেলা হয়েছে বিরোধী সদর দপ্তর৷ প্রচুর সেনা এবং পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে সেখানে৷
ছবি: Reuters/Stringer
যাঁকে ঘিরে অচলাবস্থা
মালদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের মুক্তির দাবিকে ঘিরেই উত্তাল হয়ে উঠেছে মালদ্বীপ৷ বর্তমান প্রেসিডেন্ট সংসদে সংখ্যালঘু৷ যে কোনো সময় তাঁর আসন হারানোর ভয়৷ সে কারণেই নাশিদকে জেলবন্দি করা হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ৷
ছবি: Getty Images/M.Winkelmeyer
6 ছবি1 | 6
মালদ্বীপ বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেই বলিউড এবং ক্রিকেটারদের একাংশ হঠাৎই খুব চঞ্চল হয়ে উঠছেন। মালদ্বীপ নিয়ে টুইটের বন্যা বইছে। যার সর্বশেষ ব্যক্তি স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। অক্ষয় কুমার থেকে জন অ্যাব্রাহাম, শ্রদ্ধা কাপূর থেকে সচিন টেন্ডুলকর সকলেই মালদ্বীপের মন্ত্রীদের মন্তব্যের নিন্দা করেছেন এবং লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার জন্য পর্যটকদের আহ্বান জানিয়েছেন। সকলেরই বক্তব্য লাক্ষাদ্বীপ কোনো অংশে কম নয়।
তারকাদের বক্তব্য এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরেই অতি উত্তেজিত হয়ে কেউ কেউ বলে ফেলছেন, বয়কট মালদ্বীপ। এখানেই সমস্যা। কেউ দোষ স্বীকার করে নেয়ার পরেও যদি তাকে শাস্তি দেওয়া হয়, তখন সেই ব্যবহারও সমপরিমাণ কুরুচিকর। চোখের বদলে চোখের এই সংস্কৃতি বিদ্বেষ বাড়ায়। আমি বড় এটা প্রমাণ করতে গিয়ে অন্যকে যখন ছোট করার প্রবণতা তৈরি হয়, তখন তাকে দাদাগিরি বলে।
মালদ্বীপ বিতর্ক ঘিরে যে টুইটের বন্যা বইছে তা আসলেই ওই দাদাগিরির একেকটি অন্যতম নমুনা। এই মন্তব্যগুলি আসলে মালদ্বীপের ওই মন্ত্রীদের করা মন্তব্যের মতোই কুৎসিত। মালদ্বীপের ওই মন্ত্রীদের টুইট যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তারকাদের কারও কারও মন্তব্যও তেমন সমর্থনযোগ্য নয়।
কূটনৈতিক মহলে মালদ্বীপ বিতর্ক ক্রমশ থিতিয়ে আসছে। আরো থিতিয়ে যাবে। সমাজমাধ্যমেও এবার কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ হোক। মজার বিষয় হলো, মালদ্বীপের মতো প্রবল দামি পর্যটনকেন্দ্রে সাধারণ ভারতীয়েরা যান না। যে তারকারা এসব লিখছেন, তারাই দিনের পর দিন গেছেন। অবশ্যই তারা লাক্ষাদ্বীপের জন্য গলা ফাটান। অবশ্যই সাধারণ পর্যটকদের কাছে লাক্ষাদ্বীপকে তারা প্রমোট করুন। কিন্তু তুলনা টানবেন না। দুই জায়গার সৌন্দর্যকেই একই সঙ্গে স্বীকার করে নিন।