1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙছে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২ জানুয়ারি ২০১৭

ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয় – এই স্কুলে ১,৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছাত্রী৷ প্রত্যন্ত হলেও স্বাস্থ্য সচেতনতায় রীতিমত বিপ্লব ঘটে গেছে এখানে৷ মাসিকের সময় মেয়েদের স্কুল থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে স্যানিটারি প্যাড!

ফাইল ছবিছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman

সিরাজগঞ্জের ফুলকুচা গ্রামের ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচ বছর আগেও কিন্তু চিত্রটা ছিল একেবারে বিপরীত৷ মাসিকের সময় মেয়েরা স্কুলে আসতো না৷ তারা ভয় পেত, পেত লজ্জা৷ ব্যবহার করতো পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া৷ এখন অবশ্য তারা শুধু স্যানিটারি প্যাডই ব্যবহার করে না, তাদের জন্য সার্বক্ষণিক পানি এবং আলাদা ওয়াশ রুমের ব্যবস্থাও করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি কয়েকজন প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষক রয়েছেন তাদের সহায়তা করার জন্য, কথা শোনার জন্য৷

মেয়েদের মাসিকের ব্যাপারে সচেতন করতে, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহী করতে ঐ এলকায় ২০১১ সালে ‘ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অফ দ্য রুরাল পুওর' বা ডিওআরপি নামে একটি এনজিও ‘অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম' শুরু করে৷ ডিওআরপি বা সংক্ষেপে ডর্প-এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর আমির খসরু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা শুধু স্কুলের শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটি নয়, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে সঙ্গে নিই৷ এরপর আমরা স্কুলের ছাত্রী এবং তাদের অভিভাকদের বোঝাতে সক্ষম হই যে, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড কেন প্রয়োজন৷''

Ameer Khasru - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তিনি আরো বলেন, ‘‘শুরুতে সমস্যা ছিল স্যানিটারি প্যাডের দাম৷ বাজারে প্রচলিত স্যানিটারি প্যাডের দাম অনেক৷ আমরা তাই কম দামে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড উৎপাদন করে তা সরবরাহ করি৷''

তিনি জানান, ‘‘আমরা এ পর্যন্ত ৪০টি স্কুলে এই কর্মসূচি চালু করেছি৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই কাজের সহায়ক নীতিমালা তৈরি করেছে৷''

ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমার স্কুলে এখন ছাত্রীদের উপস্থিতি বেশি৷ তারা আর মাসিকের কারণে স্কুলে আসা বন্ধ করে না৷ ভয় বা লজ্জাও পায় না৷ তারা জানে যে, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়৷''

২০১৩ সালে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ওয়াটার এইড-এর সহায়তায় ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিস রিসার্চ, বাংলাদেশ' বা আইসিডিডিআরবি-এর জরিপে দেখা যায় যে, দেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে না৷ তাঁরা পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন৷

Bithi Roy - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশের সব জেলা থেকে ২,৫০০ পরিবারের ২,১০৭ জন বয়স্ক নারী ও ৩৭৭ জন কিশোরীর তথ্য নেয়া হয়৷ এর বাইরে ৭০০ স্কুলের ২,৩৩২ জন ছাত্রীরও সাক্ষাৎকার নেয়া হয়৷ ছাত্রীদের ৬৮ শতাংশ বলে যে, প্রথমবার মাসিক হওয়ার আগে তারা এ বিষয়ে জানত না৷ আর প্রায় ৮২ শতাংশ জানায়, তারা মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে৷ দেখা যায়, বাংলাদেশের মাত্র ১ শতাংশ স্কুলে ব্যবহার করা প্যাড ফেলার ব্যবস্থা আছে৷

ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে এখন আর এই সমস্যা নেই৷ প্রতিমাসে দায়িত্বরত নারী শিক্ষকরা ছাত্রীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন৷ স্কুলেই তাদের জন্য স্যানিটারি প্যাড সংরক্ষণ করা থাকে৷''

ডর্প-এর আমির খসরু বলেন, ‘‘পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে৷ তাই অনেক প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করছে৷ কিন্তু এখনো সবখানে মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সময় লাগবে৷''

ঐ জরিপে ৪০ শতাংশ ছাত্রী জানায় যে, মাসিকের কারণে গড়ে মাসে তারা তিন দিন স্কুলে যেতে পারে না৷ এছাড়া ৩৮ শতাংশ কিশোরী এবং ৪৮ শতাংশ বয়স্ক নারীকে মাসিকের সময় ধর্মীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়৷ বিষয়টি লুকিয়ে রাখা হয় এবং লজ্জার বিষয় মনে করা হয়৷ আর সেই কারণেই তারা পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন৷

Sakir Ibrahim - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

ব্র্যাক-এর সিনিয়র সাপোর্ট স্পেশালিস্ট বিথী রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাসিক নিয়ে যে ট্যাবু আছে, সেটা ভাঙতে হবে৷ ভাইকে বুঝতে হবে বোনের প্রয়োজন৷ স্বামীকে বুঝতে হবে স্ত্রীর প্রয়োজন৷ মাসিক বিষয়টি শুধু নারী বুঝলেই হবে না৷ পরিবারের সদস্য এবং সমাজকেও এটা বুঝতে হবে৷ এটাকে একটি স্বাভাবিক শারীরিক বিষয় হিসেকে জানতে হবে, মানতে হবে৷ তাহলে আর ভয় বা লজ্জা থাকবে না৷''

বিষয়টিকে সামনে রেখেই ব্র্যাক তাদের কর্মীদের কর্মস্থল ও কর্ম এলকায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে৷ পুরুষ সহকর্মীও যাতে নারী সহকর্মীকে বুঝতে পারেন, ঘরের মানুষ যেন ঘরের নারী সদস্যের প্রয়োজনটা উপলব্ধি করে, সেই টার্গেটকে সামনে রেখেই ব্র্যাক-এর এই ক্যাম্পেইন৷ তারা এ জন্য একটি ফেসবুক গ্রুপও পরিচালনা করছে৷

বিথী রায় একজন সাইক্লিস্টও৷ তাই তাঁর পরিকল্পনা আছে, সামনে এক হাজার নারী সাইক্লিস্ট নিয়ে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে ক্যাম্পেইন করার৷ তবে এটা শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলে-মেয়ে উভয়ের সচেতনতায় কাজ করতে চান তাঁরা৷ তাঁর কথায়,‘‘বাবা যেন মেয়ের জন্য স্যানিটারি প্যাড কিনে আনেন৷ ভাই যেন বোনের জন্য কেনেন৷ সবাই যেন বুঝতে পারেন যে ময়লা কাপড় বা পুরনো ন্যাকড়া ব্যবহার কতটা ক্ষতিকর৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড যে অপরিহার্য, সেটা যে বুঝাতে হবে৷''

নারী ও শিশু বিষয়ক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করা অনুচিত৷ এর ফলে নারী ও কিশোরীরা নানা ধরনের সংক্রমণের শিকার হতে পারে৷ আর সংক্রমণ দীর্ঘদিনের হলে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘এর ফলে সাদাস্রাব বা লিকোরিয়া নামের একটা রোগ হতে পারে, যা নারীর মনোবল ভেঙে দেয়, তাকে হতাশ করে৷''

‘ডোনেট এ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ' বা ডিএপিএফএইচবি-র শাকির ইব্রাহিম মাটি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্যানিটারি প্যাডের দাম বাংলাদেশে একটি প্রধান সমস্যা৷ বাজারে এক প্যাকেট প্যাডের ডাম ১২০ টাকা৷ আমরা এটা ৩০ টাকার মধ্যে নিয়ে এসেছি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করছি৷ গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে আমরা এর পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালিয়ে আসছি৷''

Dr Abdullah Saharier - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশের স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের সাধারণত ক্লাস সিক্স থেকে মাসিক শুরু হয়৷ প্রথম মাসিক হওয়ার বিষয়টি বোঝা জরুরি৷ তাই এটার ব্যবস্থাপনা এবং এটা সম্পর্কে প্রচলিত ট্যাবু ভাঙতেও কাজ করছেন তারা৷ শাকির ইব্রাহিম বলেন, ‘‘প্যাঁচি নামে আমাদের একটি কমিক ক্যারেক্টার আছে৷ এর মাধ্যমে আমরা স্কুলগুলোতে সভা করে ছাত্রী-শিক্ষকদের সচেতন করে তুলি৷ আমাদের কিছু সেলিব্রেটি রয়েছেন৷ যেমন শম্পা রেজা, সারা জাকের, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী – এঁরা সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে অংশ নেন৷''

তবে তিনি এটাও জানান যে কাজটা শুরুতে এত সহজ ছিল না৷ বলেন, ‘‘আমি ছেলে হয়ে মেয়েদের এই বিষয় নিয়ে কেন কথা বলছি, এজন্য আমাকে নানা হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে৷ কিন্তু এখন সময় বদলাচ্ছে৷ সবাই বুঝতে শুরু করেছেন, ট্যাবু ভাঙছে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের ‘টার্গেট গ্রুপ' স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী৷ কারণ তারাই ভবিষ্যতে পরিবর্তন আনবে৷''

নোয়খালীর জমিদার হাট বিএন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ইসমাইল হোসেন ডয়চে ভেলকে এ বিষয়ে বলেন, ‘‘পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো৷ আমার স্কুলের মেয়েরা এখন তাদের ম্যাডামদের সঙ্গে সহজভাবেই তাদের শারীরিক এই পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে৷ স্কুলে রাখা স্যানিটারি প্যাড চেয়ে নেয়, ব্যবহার করে৷ তারা এটাকে এখন আর লজ্জার বিষয় মনে করে না৷ আর আমরাও মনে করি, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়৷ এরা আমাদের সন্তান৷ এদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা তো আমাদেরই কর্তব্য৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ