অতিমারীতে স্তব্ধ হয়ে যায়নি কলকাতার স্পন্দন৷ তারকা সমাবেশে গত ৮ জানুয়ারি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন শাহরুখ খান৷ করোনার বিষাদেও এ যেন রাজকীয় কার্নিভাল!
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ২০২০ সাল বিষাদেই কেটেছে৷ সিনেমা হল বন্ধ ছিল, বহু ছবি মুক্তিও পায়নি৷ ঋষি কাপুর, ইরফান খান, বাসু চ্যাটার্জি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, কিম কি দুক প্রমুখ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব প্রয়াত হয়েছেন৷ তবে নতুন বছরে কলকাতা তাদের ছাড়েনি৷ ২৬ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে(কিফ) এই সব প্রয়াত তারকাদের একটি করে চলচ্চিত্র দেখানো হবে৷ প্রত্যেক বছর নভেম্বরে এই উৎসবে দেশবিদেশের শিল্পী, কলাকুশলীরা এসে হাজির হন৷ তবে করোনায় এবারের পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ গুণগত মান একই রেখে আয়তনে সামান্য ছোট করে এবারের উৎসবের আয়োজন৷ উৎসব ঘুরে ‘থাপ্পড়’ খ্যাত পরিচালক অনুভব সিং টুইট করলেন, ‘‘কিছু শহরের মধ্যে একটা নাছোড় স্পিরিট দেখা যায়৷ কলকাতা তার মধ্যে একটা৷’’
করোনা বিধি মেনে ৪৫টি দেশের ৮১টি সিনেমা, ৫০টি শর্টফিল্ম দেখানো হচ্ছে নন্দনের তিনটি প্রেক্ষাগৃহ, রবীন্দ্রসদন, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, শিশির মঞ্চ, চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবন এবং কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে৷ বাংলা সিনেমা ২৯টি এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের ছবি ‘নোনাজলের কাব্য’৷ কিংবদন্তী শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মরণে তার অভিনীত নয়টি ছবি দেখানো হচ্ছে, থাকছে তার পরিহিত বিভিন্ন নাটকের পোশাক৷ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, এরিক রোমের, ফেদেরিকো ফেলিনির জন্মশতবর্ষে থাকছে তাঁদের নিয়ে আলোচনা৷ নানা ইনস্টলেশন, মছলিবাবার মূর্তি, বক্স অফিস লেখা অস্থায়ী তোরণ, চায়ের কেটলিতে ভরপুর নন্দন চত্বরের সিনেমাময় পরিবেশে সেলফি তোলার হিড়িক, উৎসাহী মুখ ভুলিয়ে দিচ্ছে করোনা বিষাদ৷ নন্দন চত্বরে সিনেমাপ্রেমী দর্শক সোদপুরের অপর্ণা ঘটক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নন্দনের লাইন আগের মতই দেখছি৷ তুলনামূলকভাবে কলকাতা ইনফরমেশন সেন্টার ফাঁকা৷ তবে আমরা সিনেমার থেকে সিনে তারকাদের বেশি দেখছি৷ ভয় কাটিয়ে সাধারণ মানুষের মতো কত আর্টিস্টরা এসেছেন! সৌমিত্র বা ভানুর আর্কাইভ ২০২১-এর সেরা পাওনা!’’
করোনার জেরে দেশের মধ্যে হায়দ্রাবাদে ফিল্মোৎসব হচ্ছে না, গোয়াতে দর্শকের উপস্থিতি সীমিত পরিসরে এবং সেখানে কোনো হলে উৎসব দেখানো হবে না, কেরলে উৎসব পিছিয়ে ফ্রেব্রুয়ারিতে শুরু হবে৷ সারা দেশে কলকাতাই প্রথম এমন সাহসিকতার সঙ্গে ফিল্মোৎসব করছে৷ উপরন্তু বইমেলা অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়েছে৷ তাই নন্দনচত্বরে অন্যান্যবারের মতো ভিড় না হলেও ধীরে ধীরে মানুষ আসতে শুরু করেছে৷ উৎসবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখানে বিদেশি ছবি দেখানো হচ্ছে, যা পরে আর দেখার সুযোগ হবে না৷ তাই যতদিন উৎসব চলবে, ততদিন মানুষ আসবে৷’’
প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যুগে এই জমায়েত কি নিছক কার্নিভাল নাকি সিনেমার দর্শকের ভিড়? উৎসব কর্তৃপক্ষ জানালেন, ভাল ছবির জন্য ভিড় আছে৷ আন্তর্জাতিক ছবির পাশাপাশি বাংলা ছবিতেও ভাল দর্শক হয়েছে৷ ডেলিগেট কার্ডে বা টিকিট কেটে সিনেমা দেখার পাশাপাশি সাধারণ দর্শকদের জন্য মুক্তমঞ্চে ‘দাদার কীর্তি'র মতো ছবি দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
নন্দন চত্বরে উৎসব প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেল, অনেকেই হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুখে মাস্ক নেই৷ অথচ উৎসব কর্তৃপক্ষ চারিদিকে যথেষ্ট সচেতনভাবে দূরত্ব বিধি বা মাস্কের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন৷ পোস্টারে উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায় থেকে ‘টাইটানিক’ ছবির নায়ক-নায়িকা বা ‘ব্যাটম্যান’–এর জোকার, হ্যারি পটার সকলেই মাস্ক পরে সেই সচেতনতার বার্তাই ছড়িয়েছেন৷ উৎসবকর্মী থেকে উপস্থিত তারকারাও সকলে নীল-সাদা কিফ২৬ মাস্ক পরে রয়েছেন৷ উৎসব কমিটির সদস্য, সিনেমাটোগ্রাফার প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সারা কলকাতা জুড়েই সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রদের মাস্ক পরিয়ে সচেতনার বার্তা দিয়েছি৷ মাস্ক না পরা থাকলে আমরা হলে ঢুকতে দিচ্ছি না৷ হলের ভিতর একটা সিট ছেড়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ বাইরেও দূরত্ব বিধি মানার ব্যবস্থা রয়েছে৷ তবে সবসময় কি সরকার, প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ শুধু দায়িত্ব পালন করবে? মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে৷’’
‘মহারাজা, তোমারে সেলাম’
বিশ্বের দরবারে বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রতিনিধি সত্যজিৎ রায়৷ অস্কারবিজেতা চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ, চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিক রূপেও সমাদৃত৷ ২ মে, জন্মবার্ষিকীতে তাঁর ঘর ঘুরে এসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন.....
ছবি: DW/P. Samanta
শততম জন্মদিন
বেঁচে থাকলে এই বৈশাখে শতবর্ষে পা রাখতেন সত্যজিৎ রায়৷ ১৯২১ সালের ২ মে তাঁর জন্ম৷ আমবাঙালির সঙ্গে শ্রদ্ধা পুত্র সন্দীপ রায়ের৷
ছবি: DW/P. Samanta
হলুদ বাড়ির তিনতলায়
শুধু বাড়ি বললে কম বলা হবে৷ বলা ভালো, সৃষ্টির সূতিকাগার৷ বিশপ লেফ্রয় রোডের দি প্রপার্টি ইন্ডিয়া কোম্পানির বাড়িতে সত্যজিৎ রায় ১৯৯২ সালের শেষ দিনটি পর্যন্ত কাটিয়েছেন৷ তাঁর লেখা-আঁকা আর চলচ্চিত্রের উদ্ভাবনী দক্ষতার সাক্ষী তিনতলার ঘরগুলি৷
ছবি: DW/P. Samanta
ভরা থাক স্মৃতিসুধায়
এই বাড়ির ইঁট-কাঠ-কড়ি-বরগায় এক দীর্ঘদেহী মানুষের স্মৃতি৷ তাঁকেই ছুঁয়ে দেখার চেষ্টাই যেন ভক্তদের৷ জন্মদিনে মানিকবাবুর বসার ঘর জমজমাট৷ অতিথি আপ্যায়নে তাঁর পুত্র সন্দীপ৷
ছবি: DW/P. Samanta
বারান্দার স্মৃতি
ছোটবেলা থেকেই তাঁর পছন্দ ছিল বারান্দা৷ ভবানীপুরে মামার বাড়ির বারা্ন্দা সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, ‘‘শোবার ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দা, সকাল-দুপুর-বিকেলভরে দেখতাম রাস্তায় কতরকম লোকের চলাফেরা৷’’ বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ির লম্বা লাল বারান্দা জুড়ে তাঁর কত স্মৃতি জড়িয়ে৷ পুত্রের জন্মদিনে বাবা সুকুমার রায়কেও স্মরণ৷
ছবি: DW/P. Samanta
তোমার সৃষ্টির পথ
বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার প্রথম কৃতিত্ব তাঁরই৷ কলকাতা পুরসভা বিশ্ববরেণ্য চিত্র পরিচালকের স্মৃতিধন্য বিশপ লেফ্রয় রোডকে শিল্পীর সৃষ্টিতে সাজিয়েছে৷ রাস্তার দুধারে ভিক্টোরিয়ান যুগের আদলে তৈরি আলোকস্তম্ভের সঙ্গে সত্যজিতের আঁকা পোস্টার যেন তাঁর নিবাসের দিকচিহ্ন৷
ছবি: DW/P. Samanta
দাদু-নাতি যুগলবন্দি
বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘‘...বাংলা শিশুসাহিত্য এই রায়চৌধুরীদের পারিবারিক এবং মৌরশি কারবার ভিন্ন কিছুই নয়৷’’ উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিতের তিন প্রজন্মকে কুর্নিশ জানায় বাঙালি৷ দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অসামান্য সৃষ্টি গুপী গাইন-বাঘা বাইনকে বইয়ের পাতা থেকে চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে এনেছিলেন সত্যজিৎ৷ কলকাতায় জহরলাল নেহরু রোড থেকে বিশপ লেফ্রয় রোডে ঢোকার মুখে ‘হীরক রাজার দেশে’র পোস্টার৷
ছবি: DW/P. Samanta
এ তোমার মাটি
দক্ষিণ কলকাতার লি রোডের খুব কাছেই ১/১, বিশপ লেফ্রয় রোড৷ এটাই রায় পরিবারের ঠিকানা৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর নামকরণ করেছেন ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’৷ সরণী নয়, কারণ এটাই ছিল মানিকবাবুর সৃষ্টির আপন ভুবন৷
ছবি: DW/P. Samanta
বাঙালি গোয়েন্দার বিশ্বজয়
সত্যজিৎ সৃষ্ট তুখোড়, মেধাবী, অসামান্য পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী ও অসীম সাহসী গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা সববয়সি পাঠকের একান্ত প্রিয়জন৷ রহস্যের জট ছাড়াতে তাঁকে দেশ-বিদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হলেও তিনি আদ্যোপান্ত বাঙালি যুবক৷ ছাপার অক্ষরে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময়৷ সত্যজিতের ফেলুদার ফরাসি, ইতালীয়, জাপানি ও জার্মান অনুবাদের প্রচ্ছদ৷
ছবি: DW/P. Samanta
দেশেও ফেলুদার জয়জয়কার
সত্যজিতের চলচ্চিত্রের মতো সাহিত্যের চাহিদা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায়৷ গোয়েন্দাকাহিনী থেকে আশ্চর্য সব ছোটগল্পের অনুবাদ হয়েছে৷ ওড়িয়া, গুজরাতি, মারাঠি, মালায়ালম ভাষায় অনূদিত বইয়ের প্রচ্ছদ৷
ছবি: DW/P. Samanta
চলচ্চিত্রের নেপথ্য ভাবনা
কোনও কাহিনী থেকে সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে অভিনেতার কস্টিউম থেকে কেশসজ্জা, সব কিছুতেই নিখুঁত ডিটেলিংয়ে বিশ্বাসী ছিলেন সত্যজিৎ৷ তা সে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনী হোক, কিংবা নিজের লেখা ফেলু মিত্তিরের উপন্যাস৷ সোনার কেল্লা’র জন্য ফেলুদা এবং ভিলেন মন্দার বোস ও ডাক্তার হাজরার মেক-আপ ভাবনার স্কেচ৷
ছবি: DW/P. Samanta
নিঁখুতেই নজর
খুঁতখুঁতে ছিলেন বলেই নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়তেন না৷ ফেলুদার খাস কলকাতার রহস্য কাহিনী ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’র খসড়া দেখেই সেটা বোঝা যায়৷ তাঁর হাতে লেখা খসড়াটির সঙ্গে আঁকা প্রচ্ছদ৷
ছবি: DW/P. Samanta
নতুন যুগের কেতা
সিনেমা আর গল্পের বাইরে ফেলুদা অনেক আগেই টিভি সিরিয়াল ও কমিক্সে হাজির হয়েছেন৷ এখন ব্যাটম্যান, সুপারম্যানের মতো টি-শার্টেও হাজির তিনি৷ বিপণনের জগতে ছোটদের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য নয়া রাস্তা এই ফেলুদা টি-শার্ট৷ ৩০০ টাকায় দেদার বিকোচ্ছে কলকাতার আইসিসিআর-এ৷
ছবি: DW/P. Samanta
তথ্যচিত্রে সত্যজিৎ
পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সত্যজিৎ তৈরি করেছেন তথ্যচিত্রও৷ ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘সিকিম’, ‘সুকুমার রায়’, ‘বালা’, ‘ইনার আই’ প্রভৃতি৷ তাঁর জীবন ঘিরে তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র৷ জন্মদিনে নতুন একটি তথ্যচিত্রের মুক্তি সন্দীপ রায় ও সব্যসাচী চক্রবর্তীর হাতে৷
ছবি: DW/P. Samanta
দেওয়াল জুড়ে সত্যজিৎ
ছোটদের জন্য লেখালেখি ও ছবি তৈরিতে খুব উৎসাহী ছিলেন সত্যজিৎ রায়৷ তাদের রং-তুলিতেই ফুটে উঠেছেন তিনি৷ একটি কর্মশালায় ছেলেমেয়েরা এঁকেছে সত্যজিতের পৃথিবীকে৷ নেহরু চিল্ড্রেন্স মিউজিয়ামের দেওয়ালে৷