লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, ফেস মাস্ক ইংরেজি এ শব্দগুলো শহুরে শিক্ষিত মানুষদের কাছে বেশি বোধগম্য৷ দেশব্যাপী যখন অঘোষিত লকডাউন আরোপ করা হয় তখন এ বিষয়গুলো গ্রামের মানুষের কাছে কি কোনো অর্থ তৈরি করেছিল?
বিজ্ঞাপন
উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা৷ গলির চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, বাস কিংবা রেল স্টেশন- সবখানেই মানুষের আলোচনা ঘুরেফিরে করোনা ভাইরাস নিয়ে৷ সামান্য ঠান্ডা, সর্দি হলেই কেউ কেউ যেন সন্দেহ করছে৷ করোনা ভাইরাসের প্রথমদিকে অনেকটা এমেনই ছিল রাজধানীর চিত্র৷
কিছুদিন পর শুরু হলো লকডাউন৷ পরবর্তী দুমাস প্রায় চার দেয়ালে বন্দি জীবন কাটায় ঢাকার বাসিন্দারা৷
কিন্তু কেমন ছিল গ্রামের মানুষেরা? কতটাই বা তারা বুঝতে পেরেছিল মাস্ক ব্যবহার আর সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের গুরুত্ব?
আমার সুযোগ হয়েছিল ‘লকডাউনের’ পুরো সময়টা গ্রামে কাটানোর৷ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে একটি গবেষণার কাজে বাংলাদেশে যাই৷ প্রস্তুতি ছিল মার্চের ৩০ তারিখে জার্মানি ফিরবো৷ কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহে লকডাউন আরোপ হওয়ায় দেশের সাথে সব আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, আটকে যায় আমার মতো অনেকেই৷ সেই আটকে যাওয়া এতে দীর্ঘায়িত হবে প্রথমে বুঝতে পারিনি৷ লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিন গ্রামে চলে যাই, একটু বাড়তি নিরাপত্তার আশায়৷ আর সেখানেই কাটে আমার পরবর্তী চার মাস৷
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Moore
10 ছবি1 | 10
খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিলাম করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ আশঙ্কাকে কীভাবে নেয় গ্রামের মানুষেরা৷ গ্রামীণ জনপদে স্বাস্থ্য সচেতনতা, করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার মূলমন্ত্র, তুলনামূলক কম বলে ধরা হয়ে থাকে৷
মুখে মুখে মাস্কের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমরা বিশেষ কোন একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি৷ এমনকি বাড়ি বাড়ি ঘুরে গৃহস্থালিসামগ্রী বিক্রেতাদের ঝুড়িতেও দেখা গেছে এ পণ্যটি৷ বাজারগুলোতে দেখলাম দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চলছে, তবে সবসময় যে সফল হয়েছে তা বলা যাবে না৷
সারাদিন সরব থাকা হাইওয়েগুলোতে ছিল শুনশান নীরবতা৷ নেই কোনো যান, মানুষের চলাচলও সীমিত৷ যেমনটা ভেবেছিলাম লকডাউন হয়তো শহরকেন্দ্রিকই হবে, সে ধারণাটায় কিছুটা হলেও ছেদ পড়লো আমার৷ দেখলাম, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা৷ পাড়ার ছেলেদের খেলার মাঠ থেকে গ্রামের বাজার পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করছে তারা৷ গ্রামে এমন পরিস্থিতি আমি আগে কখনো দেখিনি৷ চলাফেরা সীমিত করে দেওয়ার এ সরকারি সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে অনেকেই, সহযোগিতাও করতে দেখেছি কাউকে কাউকে৷
এর উল্টো চিত্রও বেশ পরিষ্কার ছিল৷ ফেসমাস্ক কেন ব্যবহার করতে হবে এর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় এমন অনেককেই পেয়েছি৷ এটা পশ্চিমাদের আবিষ্কার, বলেছেন কেউ কেউ৷ করোনা যখন বাংলাদেশে ধরা পড়ে, তখন গ্রীষ্মের শুরু৷ তীব্র গরমে তাই ফেসমাস্ক পরাকে বাড়তি চাপ হিসেবেই দেখেন তারা৷ দেখেছি সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়েও মানুষের বিভ্রান্তি৷
একটি বিষয়কে যদি পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা না করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এর অর্থ মানুষ নিজের মতো করে দাঁড় করাবে ও নিজ জীবনে আরোপ করবে, এটাই স্বাভাবিক৷ আর তাই উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য বিষয়ক যোগযোগবিদ্যা বলছে, যোগাযোগের সফল সূত্র হলো যাকে আপনি বলছেন তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ব্যাখ্যা করা৷
করোনা ভাইরাসের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়গুলো সমাজে খুব একটা নতুন নয়৷ যেমন ধরুন, ধুলোবালি থেকে রক্ষা পেতে শহরে কিংবা গ্রামে অনেকেই মাস্ক পরে থাকেন৷ নিয়মিত হাত ধোয়া ও পরিষ্কার থাকাও অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনের অংশ৷ এ বিষয়গুলোকে যদি তাদেরকে তাদের মতো করে বুঝানো যেতো, তাহলে হয়তো আরো ভালো ফল পেতাম আমরা৷
লকডাউনের প্রথম শিকার ছিল পরিবহণ খাত৷ এ খাতে শহরে কর্মরত প্রায় সবায়ই উপার্জনহীন অবস্থায় গ্রামে ফিরে এসেছে৷ গ্রামে ফিরেছে শহরেরে শ্রমিক শ্রেণি৷ যা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে গ্রামের সমাজে৷
এদিকে দীর্ঘ সময় আটকে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে রুটি রুজি৷ সরকারি সহয়তা যতটা পাচ্ছিল তা যথেষ্ট নয়৷ এক পর্যায়ে তারা আর পাত্তা দিতে চাইলো না স্বাস্থ্য বিধিগুলোকে, ভেঙে পড়ল লকডাউন আর সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর সব চর্চা৷
শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনা ভাইরাস থামিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকেই৷ গ্রামের মানুষের কাছে নতুন এ ধারণাটি তাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে ভালোই৷ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচারে চিরাচারিত যোগাযোগ প্রথাকে বদলে দিয়েছে৷ হয়তো আমরা আবারো আগের অবস্থায় ফিরে যাবো, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকবে লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, ফেস মাস্কের ধারণাগুলো৷