মায়ের পেশায় লজ্জিত নন এক যৌনকর্মীর সন্তান
৮ জুলাই ২০২১
মুম্বাইয়ের শ্বেতা কাট্টি বড় হয়েছেন যৌনপল্লিতে৷ প্রতিকূলতার কাছে হার না মেনে পড়াশুনো চালিয়ে গিয়েছেন৷ এ দেশের যৌনপল্লির প্রথম মেয়ে হিসেবে নিউ ইয়র্কের বার্ড কলেজ থেকে বৃত্তি পেয়ে তার স্বপ্ন আরো বিকশিত হয়েছে৷ তবে শ্বেতা একা নন, এমন স্বপ্ন দেখেন যৌনকর্মীর সন্তানদের অনেকেই৷ স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে হাঁটছেন সোনাগাছির রতন দোলুইও৷
যৌনপল্লির উন্নতিই লক্ষ্য
বড় হয়ে ওঠা সোনাগাছির যৌনপল্লিতে৷ বছর তিরিশের রতন খুব কাছ থেকে দেখেছেন যৌনপল্লির ভাল-খারাপ৷ শিক্ষা এবং সুস্থ পরিবেশের অভাব থাকলেও তিনি এখানেই স্নাতকোত্তর হয়েছেন সোশ্যাল ওয়ার্কে৷ যৌনকর্মীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য আন্দোলনের শরিক হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সোনাগাছিতে ‘স্টেট এইডস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি’তে তিনি যৌনকর্মীদের কাউন্সেলিংয়ের কাজ করেন৷ এখানে ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল প্রজেক্ট থেকে যৌনকর্মীদের চিকিৎসা করা হয়৷ বিনামূল্যে ওষুধও দেওয়া হয়৷ যৌনকর্মী-সহ প্রান্তিক মহিলাদের জীবনে মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার বা পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব কতটা তা নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ পাশাপাশি ‘আমরা পদাতিক’ নামের যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংগঠনেও কাজ করেন তিনি৷ এই সংগঠন যৌনকর্মীদের শিশুদের জীবনকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে৷
বিভিন্ন সময়ে বড় চাকরি করার প্রলোভন ফিরিয়ে দিয়ে সোনাগাছির উন্নতির জন্য পড়ে রয়েছেন দুর্বার মহিলা সমম্বয় কমিটির সংগঠনে৷ সোনাগাছির বাইরেও রাজ্যের অন্যত্র যৌনকর্মীদের সংগঠন হিসেবে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান৷ কোনটা বড় সাফল্য? রতন বলেন, ‘‘২০১৩ সালে দুর্বারের দুর্গাপুজো আয়োজন নিয়ে আমরা প্রচুর লড়াই করেছিলাম৷ রাস্তার মধ্যে যৌনপল্লির বাসিন্দারা দুর্গাপুজো করবে, এটা সমাজ মেনে নিতে চায়নি৷ মহামান্য হাইকোর্টের সহযোগিতাতে এই সাফল্য পেয়েছি৷’’
শিশুদের অবস্থান
শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ কেমন এখানে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রতন বলেন, ‘‘যৌনকর্মীদের সন্তানরা অনেক বেশি প্রতিকূলতার মুখে যেমন পড়ে, তেমনি অনেক এক্সপোজারও পায়৷ অনেকের নিজেকে প্রকাশে সমস্যাও যেমন থাকে, তেমনই অনেক শিশু খুব বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌতূহলী হয়৷’’
লকডাউনে পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের সমস্যা বেড়েছে৷ বাদ নেই শিশুরাও৷ রাজ্য সরকারের দেওয়া শুকনো খাবারে কি সব সমস্যার সমাধান হয়? রতন বলেন, ‘‘ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক ভুয়ো খবরে অনেক যৌনকর্মীই ভ্যাকসিন নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন৷ তাদের বুঝিয়ে ভ্যাকসিন দিতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ৷ আমরা সে চেষ্টাই করি৷ অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, সেগুলি রাজ্যের যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের মধ্যে বিলি করছি৷’’
শ্বেতা কাট্টির মতো মেয়েদের লড়াই কতটা কঠিন? রতনের বক্তব্য, ‘‘সংবাদমাধ্যমে যৌনকর্মীদের মেয়েদের প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হয়, তুমি কি তোমার মায়ের পেশায় পরবর্তীকালে আসতে চাও৷ মেয়ে হিসেবে শুধু এই প্রশ্নটা কেন করা হবে? যৌনকর্মীর সন্তান বলে শুধু যৌনকর্মীই বা তাকে হতে হবে কেন? সমাজ যতদিন তার দৃষ্টিভঙ্গি বদল না করবে, ততদিন সমাজ এগোবে না৷ শ্বেতাকেও নিশ্চয়ই এ সবের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে৷’’
রতন অনেকের অনুপ্রেরণা
রতনদের মতো যারা উঠে আসছেন, তারাই সমাজ পাল্টানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন বৈকি! পড়াশুনো, ছবি আঁকার পাশাপাশি রতন সঙ্গীতের জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন৷ গানে প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে তৈরি ‘দুর্বার ব্যান্ড’ থেকে শুরু করে জনপ্রিয় রিয়েলিটির শোয়ের মঞ্চে উপস্থিতি বা অ্যালবাম প্রকাশ, সবেতেই অনেকটা পথ এগিয়েছেন তিনি৷ রতন গর্ব করে মায়ের পরিচয় দেন৷ তিনি হয়ে উঠেছেন আরও অনেক যৌনকর্মীর সন্তানদের আদর্শ৷ বারুইপুরের হোমে থাকা একটি শিশু যথেষ্ট পড়াশুনোয় ভাল৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় রতনকে দেখে সে তার মতো হতে চায়৷ আবার এক যৌনকর্মীর সন্তান ভূগোলে স্নাতকে পড়ছে৷ তারও লক্ষ্য রতন দোলুইয়ের মতো৷ কিন্তু কেন? সমাজের প্রতিবন্ধকতার আগল ছিঁড়ে যৌনকর্মীর সন্তানরাও যে স্বপ্ন দেখতে চায়৷ রতন বলেন, ‘‘আমি যেহেতু কষ্ট করেছি, তাই অন্যদের সাহায্য করতে চেষ্টা করি৷ আর্থিক সাহায্যও দিই৷ দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ স্মরজিৎ জানার সাহায্য না পেলে আমিও এত দূর আসতে পারতাম না৷’’