মা ইলিশ বলে কথা৷ ডিম না দিলে ইলিশের উৎপাদন যে বাড়বে না৷ ওদিকে, ইলিশের টুকরো বিনা বাঙালির উদরপূর্তি হয় না৷ তাই হাসিনা সরকার এবার নদীতে সেনা টহলের ব্যবস্থা করেছে ইলিশ ধরা বন্ধে, গ্রেপ্তারও ৯০০'র বেশি৷
বিজ্ঞাপন
গোটা বিশ্বের মধ্যে ৬০ শতাংশ ইলিশই ধরা পড়ে বাংলাদেশে৷ কিন্তু জেলেরা নির্বিচারে ধরায় ইলিশের আধার ক্রমশ ছোট হতে শুরু করে, যার প্রভাব পড়ে নিম্নবিত্ত বাঙালির উপর৷ দাম যাচ্ছিল বেড়ে, ফলে ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল গরিবরা৷
হাসিনা সরকার এই অবস্থা পরিবর্তনে ইলিশ ধরায় বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ গত ১২ অক্টোবর থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷ কেননা এই সময়ে যে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ৷ তাই ইলিশ ধরা চলবে না কিছুতেই৷
অবশ্য এমন নিষেধাজ্ঞা আগেও জারি হয়েছিল৷ কিন্তু কাজ তেমন হয়নি নিষেধাজ্ঞা পালনে কড়াকড়ি না থাকায়৷ এবার তাই সাত হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমায় টহল দিয়েছে সেনাবাহিনী৷
ইলিশ বাঁচাতে সেনা নামানোর দরকারটা এককথায় বুঝিয়ে দিলেন ইকবাল হোসেন৷ সরকারের মৎস বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘একটা মা ইলিশ বছরে বিশ লাখ ডিম ছাড়ে৷ এবার হিসেব করুন, তাদের বাঁচাতে পারলে উৎপাদন কোথায় পৌঁছাবে৷''
ইলিশ রক্ষায় বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ
ইলিশকে বাংলাদেশে ‘মাছের রাজা’ হিসেবেই মানেন সবাই৷ দেশের বাইরেও পদ্মার ইলিশের অনেক কদর৷ সেই ইলিশ হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ৷ তবে সুদিন আবার ফিরছে৷ উৎপাদন বাড়ছে৷ ইলিশ উৎপাদনে সারা বিশ্বের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ৷
ঈদ, পুজো, পহেলা বৈশাখ- উৎসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক যে ধরণেরই হোক না কেন, ইলিশ ছাড়া কিন্তু বাঙালির ভোজন জমে না৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
ইলিশে বসতি বাণিজ্য
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ৷ আর দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশই ইলিশ৷ বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে আছেন৷ এছাড়াও প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ৷ মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে৷
ছবি: Imago/UIG
ইলিশ থেকে ওষুধ
ইলিশ খুব তেলতেলে মাছ৷ সম্প্রতি সেই তেলেরও বিশেষ এক গুণের কথা জানা গেছে৷ জানা গেছে, ইলিশ মাছে যে ‘ওমেগা-৩’ ধরনের তেল আছে, তা দিয়ে ওষুধ তৈরি করা যায়৷ হৃদরোগসহ বেশ কিছু রোগ সারানোয় ভূমিকা রাখতে পারে এই ওষুধ৷ ইতিমধ্যে ইলিশের তেল থেকে ওষুধ তৈরি করা শুরু করেছে বেশ কিছু দেশ৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
দুঃসময়ের পদধ্বনি...
ইলিশের দুর্দিন মানে ভোজনরসিকদের দুর্ভাবনা৷ ইলিশ কমতে শুরু করায় বাংলাদেশও পড়েছিল দুর্ভাবনায়৷ তার প্রভাব এমন কিছু দেশে পড়েছিল যেসব দেশের মানুষ পদ্মার ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকে৷ বাংলাদেশ, ভারত বা শুধু এশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশ নয়, ইউরোপ-অ্যামেরিকাতেও ইলিশ আজকাল পাতে উঠছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু দেশে ইলিশের স্যুপের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে৷
ছবি: Imago/UIG
সংকটের কারণ...
ইলিশ কমতে শুরু করেছিল মূলত দুটি কারণে৷ এক, অতিরিক্ত মাত্রায় মা ও জাটকা ইলিশ ধরা; দুই, ব্যাপক পরিবেশ দূষণ৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই ইলিশ কমতে শুরু করেছিল৷ তবে খুশির কথা, ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Chowdhury
ইলিশ রক্ষায় পদক্ষেপ
২০০২ সালের পর থেকে ইলিশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ৷ ডিম পাড়া ও বিচরণের স্থান চিহ্নিত করা, বছরের আট মাস জাটকা ধরা এবং ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করার সুফল এখন পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ৷ জেলেদের প্রতিও দেয়া হয়েছে বিশেষ মনযোগ৷ ইলিশ ধরেন এমন জেলেদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ লাখ ২৪ হাজার জনকে পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ছে ইলিশ, আসছে সুফল
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইলিশের দুর্দিন অনেকটাই কেটে গেছে৷ ইলিশ ধরা বেড়েছে, পাশাপাশি ইলিশও বাড়ছে৷ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে ২০০৯-১০ মৌসুমে দুই লাখ টন ইলিশ ধরা হয়, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়ে যায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন, ২০১৫, অর্থাৎ চলতি বছর চার লাখ টন ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর৷
ছবি: Imago/UIG
বাংলাদেশ সবার কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, সারা বিশ্বে মূলত যে ১১টি দেশে ইলিশ হয় সেগুলোর মধ্যে ১০টিতেই ইলিশ কমছে, শুধু বাংলাদেশেই লক্ষণীয় মাত্রায় উৎপাদন বাড়ছে৷ বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার বছরে শতকরা ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো৷ ফলে ইলিশ রক্ষায় অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশ এখন ‘রোল মডেল’৷
লেখাবাহুল্য, বাঙালির কাছে সবচেয়ে বেশি কদর ইলিশের৷ শুধু বাংলাদেশের ১৬ কোটি নয়, পশ্চিমবঙ্গের নয় কোটি বাঙালিরও উৎসব-পার্বণে পাতে চাই ইলিশ৷ ইলিশ রক্ষার সাম্প্রতিক উদ্যোগকে তাই রীতিমত যুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দিলেন মাছ রক্ষার এক আন্দোলনের কর্মী জাহিদ হাবিব৷ তাঁর কথায়, মা ইলিশদের রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে৷
গত কয়েকবছর ধরেই অবশ্য বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে বাংলাদেশ৷ এবার তা বাস্তবায়নে কঠোর হয়েছে সরকার৷ এছাড়া পাঁচ বছর আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতে সুস্বাদু এই মাছ রপ্তানিও নিষিদ্ধ করেছে মুসলিমপ্রধান দেশটির সরকার৷
সমালোচকরা অবশ্য বলছেন, ইলিশ বাঁচানোর এই কড়াকড়িতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মাঝিরা৷ তবে হোসেন সে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন৷ মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়টাতে নাকি ৩২ হাজার জেলেকে বিনামূল্যে চাল দিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ তাই তাদের আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও তা পুষিয়ে দেয়া হয়েছে বলেই দাবি তাঁর৷