মিউনিখ ও তার চারপাশের গ্রামগঞ্জ যে ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক্স আয়োজনের প্রার্থী হবার বিরুদ্ধে এ ভাবে রুখে দাঁড়াবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল! কিন্তু বোঝা গেল: জার্মানরা এ ধরনের মেগা স্পোর্টস ইভেন্টের বিরোধী৷
বিজ্ঞাপন
বলতে কি, মিউনিখের ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক্স পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ভালোই ছিল, কেননা রবিবার পর্যন্ত মাত্র আর দু'টি শহর সরকারিভাবে তাদের প্রার্থী হবার অভিপ্রায় জানান দেয়: কাজাখস্তানের আলমাটি ও ইউক্রেনের লভিভ৷
অথচ মিউনিখ ও তার আশেপাশের তিনটি বসতির বাসিন্দারা ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক্স-কে মিউনিখে আনার পরিকল্পনা একরকম নির্দয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করল৷ এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ২০১৮ সালের শীতকালীন অলিম্পিক্স মিউনিখে আনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় ঠিক এর দু'বছর আগে৷
কাজেই মিউনিখবাসীদের ‘না' শুনে অলিম্পিক্স-সমর্থক মহলের মাথা মাথা ব্যক্তিত্ব রীতিমতো ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছেন: কেউ ক্ষুব্ধ, কেউ ক্ষিপ্ত৷ ফ্রানৎস বেকেনবাউয়ার গণভোটের ফলাফলকে বলেছেন ‘‘বোকা'' এবং ‘‘সুযোগের অপচয়''৷ অলিম্পিক স্কিয়িং চ্যাম্পিয়ন মারিয়া হ্যোফল-রিশ এই ভোটকে বলেছেন ‘‘সংকীর্ণমনা''৷
আনন্দে ভাসছে টোকিও
২০২০ সালের অলিম্পিক আয়োজনের সুযোগ পেয়েছে জাপান৷ ৪৮ বছর পর আবার ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি এলো টোকিওতে৷ জাপানের রাজধানী তাই ভাসছে আনন্দের বন্যায়৷
ছবি: Getty Images
‘আমরা পেরেছি, আমরা পেরেছি!’
আয়োজক হওয়ার লড়াই খুব কষ্টে জিততে হয়েছে টোকিওকে৷ সবাইকে অবাক করে গোপন ভোটাভুটির প্রথম পর্বে বাদ পড়ে যায় মাদ্রিদ৷ স্পেনের তখনই স্বপ্নভঙ্গ হলেও তুরস্ক টিকে ছিল৷ কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে ইস্তানবুল পেয়েছে মাত্র ৩৬ ভোট আর টোকিও ৬০ ভোট৷ ফলে তুরস্কে নেমে আসে হতাশা আর টোকিওবাসি ভাসে আনন্দ-উল্লাসে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
সুখেও কেঁদে ওঠে মন...
অলিম্পিক-লড়াই জিততে জি-টোয়েন্টি সম্মেলন থেকে শিনজো আবে সরাসরি চলে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে৷ রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে সেখানে গিয়ে অবশ্য মন খারাপ করে ফিরতে হয়নি জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে৷ টোকিওর আয়োজক হবার দাবি আদায় করেই ফিরেছেন৷ আনন্দে সবাই যেখানে হাসে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী তখন অনেকটা কাঁদতে কাঁদতেই বলেছেন, ‘‘২০২০ অলিম্পিকের আয়োজক হয়ে আমরা নতুন আশার জন্ম দেবো৷ ’’
ছবি: picture alliance/dpa
‘আগামীকে আবিষ্কার করো’
২০২০ অলিম্পিকের স্লোগানটা কিন্তু দারুণ – আগামীকে আবিষ্কার করো৷ টোকিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ডিজাইনেও রয়েছে ভবিষ্যৎ ভাবনার ছাপ৷ ডিজাইনার কিন্তু জাপানি নন৷ ইরাকি-ব্রিটিশ স্থপতি নারীর নাম জাহা হাদিদ৷ স্টেডিয়াম তৈরির কাজ এখনো শুরু হয়নি৷ জাহা হাদিদের ডিজাইনের বাস্তবায়ন শুরু হবে শিগগিরই৷
ছবি: Tokyo.jp
১৭ হাজার শয্যা
স্টেডিয়ামের মতো অলিম্পিক ভিলেজও থেমে আছে ডিজাইনারের কাগজে৷ তবে ছবির গ্রাফিক্স দেখেই অনুমান করা যায় ক্রীড়াবিদদের জন্য কী এলাহি কাণ্ড হতে চলেছে৷ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নিয়ে ক্রীড়াপল্লিটি তৈরি হবে ৪৪ হেক্টর জমির ওপর৷ সেখানে বিছানাই থাকবে ১৭,০০০টি৷
ছবি: tokyo2020.jp
ভয় নেই!
ফুকুশিমার নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের দুর্ঘটনা টোকিওর আয়োজক হবার পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল৷ তেজস্ক্রিয়তার আতঙ্ক একটু হলে দৌড় থেকে ছিটকে দিতো টোকিওকে৷ শিনজো আবে আশ্বস্ত করেছেন বলে রক্ষা৷ জাপানের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)-কে জানিয়েছেন, ফুকুশিমার পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে৷ তাছাড়া ফুকুশিমা যে টোকিও থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে – এ কথা জানিয়ে সবাইকে নিশ্চিন্তও করেছেন তিনি৷
ছবি: Reuters/Tokyo Electric Power Co
মেগাসিটি
টোকিও যেনতেন কোনো রাজধানী শহর নয়৷ রীতিমতো মেগাসিটি৷ সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী টোকিওতে এখন ৯০ লাখ মানুষের বাস৷ শহর কেন্দ্রের বাইরের বৃহত্তর এলাকা জুড়ে রয়েছে সাড়ে তিন কোটি মানুষ৷ অসংখ্য সুউচ্চ ভবন রয়েছে টোকিওতে৷ এত লোকের বাস সম্ভব হয়েছে সে কারণেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জাপান পারে...
পৃথিবীর আর কোনো শহরে সম্ভবত টোকিওর মতো এত লোক এত সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিদিন যাতায়াত করেন না৷ যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য টোকিও সবসময়ই বিশেষ প্রশংসিত৷ রাজধানীর শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ প্রতিদিন ট্রেনে চড়েন৷ অটোমেটেড গাইডওয়ে ট্রানজিট ‘ইউরিকামোম’ কী অসাধ্যই না সাধন করে চলেছে!
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মরণে ১৯৬৪
টোকিওতে প্রথমবার অলিম্পিক হয়েছিল ১৯৬৪ সালে৷ অথচ তার ২৪ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৪০ সালেই হতে পারতো সেই সৌভাগ্য, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধের কারণে সুযোগটি সেবার হাতছাড়া হয়ে যায়৷ বিশ্বযু্দ্ধের ধকল কিছুটা সামলে ওঠা জাপানে ১৯৬৪ সালের অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল ৯৩টি দেশ৷ মোট প্রতিযোগী ছিল পাঁচ হাজার একশ একান্ন জন৷ ২০২০ সালের আসরে অংশগ্রহণকারী দেশ এবং প্রতিযোগী কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তাঁর হাতে অলিম্পিক মশাল
ইয়োশিনোরি সাকাই-এর জন্ম ১৯৪০ সালের এক কালো দিনে৷ সেদিন হিরোশিমায় আণবিক বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ তাই জন্ম তাঁর মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে৷ তবে এ জনম অনেকটা সার্থক হয় ১৯৬৪ সালে৷ অলিম্পিক মশাল টোকিওতে আসে তাঁর হাত ধরে, সারা বিশ্বের জন্য শান্তির বার্তাও ছিল সঙ্গে৷
ছবি: Getty Images
9 ছবি1 | 9
তবে অলিম্পিক্স গোত্রীয় বড় বড় প্রতিযোগিতা আয়োজনের পিছনে আগে যে গ্ল্যামার ছিল, এখন তা অনেকটা রংচটা হয়ে এসেছে৷ মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটলান্টা শহর ঘোষণা করে, ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্সের মূল স্টেডিয়ামটি ভেঙে সেখানে মধ্যবিত্তদের জন্য হাউজিং কলোনি সৃষ্টি করা হবে৷
ব্রাজিলে ২০১৪-র বিশ্বকাপের আগে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ চলেছে৷ কাতারে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য স্টেডিয়াম নির্মাণে বিদেশি শ্রমিকদের যে ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে, কিংবা সোচি-তে ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যেভাবে পরিবেশের হানি থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়ার অতিথি শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক আচরণের কারণে সমালোচনার ঝড় উঠেছে – এ সবই মেগা স্পোর্টস ইভেন্টগুলির জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ অথবা উপলক্ষ্য, দুই'ই হতে পারে৷
এ সব ইভেন্ট আয়োজনের আর্থিক দিকটাও ক্রমেই আরো বেশি খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে৷ আইওসি-র কিছু কন্ট্র্যাক্ট'কে ‘‘জবরদস্তি'' বলে অভিযোগ করেছেন মিউনিখের অলিম্পিক-বিরোধীরা৷ এছাড়া শুধু আবেদন করার খরচই এখন যা দাঁড়িয়েছে, তাতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্স আয়োজনের অনুমোদন পাবার অভিযান চালাতে প্রার্থী শহর কিংবা দেশের দশ কোটি ডলার খরচ হওয়াটাও আশ্চর্য নয়৷
মাইকেল পেইন বহুদিন ধরে আইওসি-র মার্কেটিং ডাইরেক্টর ছিলেন৷ তিনিও স্বীকার করেছেন যে, বর্তমান প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল, আমলাতান্ত্রিক এবং ব্যয়বহুল৷ তাঁর মন্তব্য: ‘‘নরওয়ের লিলেহ্যামার-কে যদি আজকের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো, তাহলে তারা প্রার্থী হতে চাইতে কিংবা পারতো বলে আমার মনে হয় না৷ অথচ তারা সবচেয়ে সফল শীতকালীন গেমস-গুলির মধ্যে একটির আয়োজন করে (১৯৯৪ সালে)৷''
নতুন আইওসি প্রেসিডেন্ট টোমাস বাখ – যিনি জার্মানির মানুষ – তিনিও মনে করেন আবেদন প্রক্রিয়ার সংস্কার ঘটা প্রয়োজন৷ গত সেপ্টেম্বরে আইওসি-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘হয়তো আমরা ওদের (অর্থাৎ আবেদনকারী শহরগুলির) কাছ থেকে বড় বেশি চাইছি৷'' মাইকেল পেইনের মতে, ব্রাজিলের ঘটনাবলী থেকে প্রমাণ হয় যে সরকারের একটা সর্বাঙ্গীণ পরিকল্পনা থাকা উচিত – শুধু আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নয়৷ বিশ্বকাপের মতো কোনো বড় ইভেন্ট আয়োজনের প্রক্রিয়া, পণ্য এবং চূড়ান্ত ফলশ্রুতি মঙ্গলজনক হওয়া চাই৷ নয়তো কালে প্রার্থীর অভাব ঘটতে পারে৷