মিজলস বা হাম যে কোনো বয়সের মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে৷ কোলন শহরে অনেক রোগীর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ পৌর কর্তৃপক্ষ প্রচার অভিযান ও টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ভবিষ্যতে বিপদ থেকেই যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Spata
বিজ্ঞাপন
২০১৮ সালের জুন মাসে এক অন্তঃস্বত্ত্বা নারী সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময়ে মিজলেসে আক্রান্ত হলেন৷ উচ্চ তাপমাত্রার জ্বরের কারণে মা ও সন্তানের প্রাণের সংকট দেখা দিলো৷ বিচ্ছিন্ন এক ওয়ার্ডে তিনি সন্তানের জন্ম দিলেন৷ ভাগ্যক্রমে দুজনেই সুস্থ হয়ে উঠলেন৷
হাসপাতালে হামের রোগীদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো৷ ত্বকের সমস্যার পাশাপাশি তাঁদের ফুসফুসে সংক্রমণ ও অন্যান্য জটিলতাও দেখা যেতে লাগলো৷ এমার্জেন্সি বিভাগের প্রধান মিশায়েল ক্রাকাউ বলেন, ‘‘অনেকে উঠে দাঁড়াতেই পারেন না৷ বিছানা থেকে উঠতে না পারায় এমনকি রোগী হিসেবে তরুণ-তরুণীদেরও এক সপ্তাহ ধরে ডায়াপার পরে থাকতে হয়৷ মস্তিষ্কেও মারাত্মক ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হতে পারে৷ কখনো শুধু রোগের সময় তীব্র আকার ধারণ করে, কখনো আবার সাত-আট বছর পর মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে৷ তখন কিছুই করার থাকে না, মৃত্যু প্রায় অবধারিত৷’’
এর মধ্যে কোলন শহরে মিজলস রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১৩৫ ছুঁয়েছে৷ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে স্বাস্থ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত টিম ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত থেকেছে৷ তা সত্ত্বেও এই রোগের প্রসার থামানো সম্ভব হয় নি৷ ফলে স্বাস্থ্য দপ্তরকে আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে হয়েছে৷
শিশুরোগের লক্ষণ চিনুন, মারাত্মক ক্ষতি থেকে দূরে থাকুন
প্রতিটি মা-বাবার কাছে সন্তানের সুস্থতার চেয়ে মূল্যবান বোধহয় আর কিছু নেই৷ তাই শিশুরোগের লক্ষণগুলো জানা থাকলে সন্তানের জীবন সহজ ও সুন্দর হতে পারে৷ ছবিঘরে থাকছে এ বিষয়েই বিশেষজ্ঞের দেওয়া কিছু পরামর্শ৷
ছবি: Fotolia
শিশুর টিকা
শিশুর জন্মের এক বছরের মধ্যে হুপিং কাশি, দিপথেরিয়া, টিটেনাস, পোলিও, হাম, মাম্স এবং জলবসন্তের টিকা ইত্যাদি অবশ্যই দিতে হবে৷ তাছাড়া আরো কিছু টিকা রয়েছে যেগুলো পরে কিশোর বয়সে আবারও নতুন করে দিতে হয়৷ শিশুর স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি টিকাই নির্দিষ্ট সময়ে দেয়া প্রয়োজন৷ তবে এ বিষয়ে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.J. Hildenbrand
রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু শিশুরোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক৷ যেমন হাম৷ জার্মানির শিশু-কিশোর অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ডা. এসারের ভাষায়, ‘‘অনেকের ধারণা হাম ক্ষতি করে না৷ অথচ এটি একটি সংক্রমণ রোগ, যা নার্ভ বা স্নায়ু সিস্টেমকে আক্রমণ করতে পারে৷ হামের পর শতকরা ১০ জন শিশুর মস্তিষ্কের তরঙ্গে পরিবর্তন হয় আর অন্তত একজনের মাথায় থেকে যায় মানসিক ব্যাধির লক্ষণ৷
ছবি: imago stock&people
শিশুর জ্বর
প্রায়ই দেখা যায় কোনো অসুখ হওয়ার আগে শিশুদের জ্বর হয়৷ তাই জ্বরকে মোটেও হালকাভাবে নেয়া বা নিজে থেকে জ্বরের ওষুধ দেয়া কখনোই উচিত নয়৷ তবে এক শিশুর জ্বর হওয়ার আগে যদি তার বড় বা ছোট ভাই-বোনের ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ হয়ে থাকে, তাহলে দু-একদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Agencia Estado
পান করতে না চাইলে
শিশুদের শরীরে তরল মজুদ রাখার সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷ তাই শিশু জল বা অন্য কোনো পানীয় পান করতে না চাইলে, খুব তাড়াতাড়ি শিশুদের শরীরের ভেতরটা শুকিয়ে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে৷ তাই শিশু পান করতে না চাইলে বা অনেকটা সময় কোনো তরল পদার্থ পান না করে থাকলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত৷
ছবি: Fotolia/Zsolt Bota Finna
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
কথা না বলা, না হাঁটা, খেলা না করা বা কানে কম শুনছে মনে হলে খুব বেশি চিন্তা না করে ডাক্তারের কাছে যাওয়াই স্রেয়৷ কারণ সব শিশু একই বয়সে একই কাজ করে না৷ কেউ হয়ত ১০ মাস বয়সেই হাঁটতে শুরু করে আবার কেউ ১৪ মাসেও হাঁটে না৷ তাছাড়া অনেক শিশু হামগুড়ি না দিয়েই হাঁটতে শুরু করে৷ এ বিষয়গুলো অনেক সময় বংশগত কারণেও হয়ে থাকে৷
ছবি: Fotolia/deber73
অযথা অসুখ খুঁজবেন না!
‘‘অকারণে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন না৷ তবে কোনো কিছু অন্যরকম মনে হলে বা কোনো দ্বিধা থাকলে প্রয়োজনে নিজের মা বা মুরুব্বিদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন৷ সারাক্ষণ শিশুকে অসুস্থ মনে করলে বা সে কথা তাকে বললে, তা শিশুমনে প্রভাব ফেলে৷ এবং পরবর্তীতে শিশুকে তা সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলতে পারে৷’’ বলেন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এসার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Schlesinger
নিজের মতো চলতে দিন
নিজের ৩১ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ডা. এসার বলেন, ‘‘ছোটখাটো ব্যাপারে শিশুকে বিরক্ত না করে, তাকে তার মতো চলতে এবং অন্য শিশুদের সাথে খেলতে দিন৷ খেলার মধ্য দিয়ে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, ওরা হয় ওঠে আত্মবিশ্বাসী৷ লক্ষ্য রাখুন শিশুর আগ্রহ কোন দিকে৷ কারণ বেশি জোড় করলে শিশু মনে তার প্রভাব পড়ে এবং মনোজগতে ক্ষতচিহ্ন থেকে যায়৷’’
ছবি: Fotolia/Fotofreundin
মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরে রাখুন
একটা শিশু কিন্তু বুঝতে পারে না, কী কারণে তার মা অন্যের সাথে টেলিফোনে বা সরাসরি বাবার বদনাম বা সমালোচনা করছেন৷ শিশুরা এ সব নিয়ে কোনো প্রতিবাদ বা আলোচনা করতে পারে না ঠিকই, তবে শিশুমনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে সৃষ্টি হয় মানসিক দ্বন্দ্ব৷ তাই দাম্পত্য কলহ কখনই শিশুদের সামনে নয়! মা-বাবার ঝগড়া সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে৷
ছবি: Fotolia
8 ছবি1 | 8
শহরের বিভিন্ন অংশে স্পষ্ট হোর্ডিং-এর মাধ্যমে নাগরিকদের টিকা নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে৷ কোলন স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মকর্তা প্রো. গেয়ারহার্ড ভিসম্যুলার বলেন, ‘‘তারপর শহরের পরিবহণ কোম্পানির ইলেকট্রনিক বোর্ডে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে টিকার অবস্থা পরীক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ শহরের প্রধান ফুটবল ক্লাবকে দিয়ে অনুরাগীদের এ বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে৷’’
ফুটবল ক্লাব ও গণপরিবহণ কোম্পানির সাহায্যে সেই সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে, মিজলস মোকাবিলার ক্ষেত্রে যাদের যথেষ্ট সুরক্ষা নেই৷ স্বাস্থ্য দপ্তর শহরের বিভিন্ন অংশে ভ্রাম্যমাণ টিকা কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে৷ ডাক্তাররা টিকার খাতা পরীক্ষা করে পরামর্শ দিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে টিকা দিয়েছেন৷ সাধারণত এই টিকার কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না৷ তবে দশ শতাংশ পর্যন্ত মানুষের ক্ষেত্রে সুচ ফোটানোর জায়গা ফুলে লাল হয়ে ওঠে৷ ব্যথা ও জ্বরও হতে পারে৷
অবশেষে সাফল্য এলো৷ নতুন করে আর কেউই প্রায় হামে আক্রান্ত হলো না৷ আক্রান্তদের সংখ্যা ১৩৯-এ স্থির রইলো৷ ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে কোলন শহরে নতুন করে কেউ আর মিজলসে আক্রান্ত হলেন না৷ মহামারি বন্ধ হলো৷ তবে সব জায়গায় এমন সাফল্য দেখা যায় নি৷ যেমন ডুইসবুর্গ ও এসেন শহরে ২০১৭ সালে ২৮৫ জনের হাম হয়েছে৷ এক নারীর মৃত্যু হয়েছে৷ ২০১৫ সালে বার্লিনে ১,৩৪৪ জন আক্রান্ত হয়েছে৷ একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে৷
কোলন শহরের রোগীরা রোগের ধকল সামলে উঠতে পেরেছেন৷ আলেক্স সাউয়ারও আবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন৷ তবে রোগের পর থেকে তাঁকে চশমা পরতে হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এক সপ্তাহ ধরে ভীষণ জ্বর, ব্যথা, অবসাদ, ঘুম ও খিদের অভাবের পর আমি সবাইকে বলবো, মৃত্যুর এই ভয়, আতঙ্ক, অসহায় অবস্থা এড়িয়ে চলুন৷ ডাক্তার দেখিয়ে প্রয়োজনে টিকা নিন৷ ব্যস, সব ভালো থাকবে৷’’
কোলন শহর আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে৷ তবে কোনো এক সময়ে আবার মিজলস ফিরে আসবে, নতুন করে মহামারি দেখা দেবে৷ কারণ এই রোগ এখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি৷
এফা শুলটেস/এসবি
গতবছরের জানুয়ারির ছবিঘরটি দেখুন...
ইউরোপে ‘হাম’ রোগের প্রকোপ বাড়ছে
হাম রোগের প্রকোপ বাড়ার কথা জানা যায় গতবছর প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট থেকে৷ অবশ্য চলতি বছরে সারা ইউরোপে হাম রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে গত বছরের চেয়েও বেশি৷ বিস্তারিত থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাত্র ছ’মাসে...
২০১৮ সালের প্রথম ছ’মাসে ইউরোপে ৪২,০০০ মানুষ হামের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন৷
ছবি: imago stock&people
টিকা না নেওয়ার কারণে
হামের বিরুদ্ধে টিকা না নেওয়াই হামে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জার্মানিতে টিকার হার
বর্তমানে জার্মানিতে হামের টিকা নেওয়ার হার শতকরা ৯৩ ভাগ৷
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণী
হাম ভাইরাস নিয়ে ২০১৭ সালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবাণী দিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/Keystone/U. Flueeler
ডাব্লিউএইচও-র লক্ষ্য হাম নির্মূল করা
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগ্যানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হাম নির্মূল করা৷ অ্যামেরিকা মহাদেশ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে ইতিমধ্যেই এটি করতে সফল হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Keystone/U. Flueeler
জার্মানি
হাম একটি ছোঁয়াচে রোগ৷ অনেক মা-বাবা এই রোগকে তেমন গুরুত্ব দেন না বলেই অনেক শিশু অন্যশিশুদের সাথে খেলার ফলে হামে সংক্রমিত হয়৷ তাই এ রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি, প্রয়োজন টিকা নেওয়াও৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Schlesinger
হামকে অনেকে তেমন গুরুত্ব দেন না
অনেকে মনে করেন, হাম তেমন ক্ষতিকর কোনো অসুখ নয়৷ তবে হাম সম্পর্কে জার্মানির রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট জানায় যে, হাম থেকে মস্তিষ্কে সংক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে৷ তবে তা হাজারে মাত্র একজনের হয়ে থাকে এবং এদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে৷