মিজোরামে বাঙালি শ্রমিকদের মৃত্যুর দায় কার?
২৪ আগস্ট ২০২৩এর মধ্যে একই পরিবারের চারজন মারা গিয়েছেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কি বাইরেই যেতে হবে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের?
দুর্ঘটনায় বাঙালি শ্রমিকরা
ভারতের উত্তর-পূর্বের মিজোরাম রাজ্যের রাজধানী আইজল থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে রেল সেতু নির্মাণের কাজ হচ্ছিল। বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ সেতুর দুটি স্তম্ভের মধ্যে ইস্পাতের কাঠামো ভেঙে পড়ে। সেই সময় জনা ২৬ জন শ্রমিক কাঠামোর উপরে কাজ করছিলেন। তাদের অধিকাংশই এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।
মৃত ২৩ জন শ্রমিক মালদহ থেকে মিজোরামে কাজ করতে গিয়েছিলেন। এদের ১১ জন এই জেলার রতুয়ার একটি গ্রামেরই বাসিন্দা। ইংরেজবাজার, গাজোল ও কালিয়াচক থেকে যাওয়া শ্রমিকরা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। এর মধ্যে ইংরেজবাজারের একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজনৈতিক তরজা
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মৃতদের পরিবার পিছু দু'লক্ষ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে। রেল মৃত শ্রমিকের পরিবারপিছু দেবে ১০ লক্ষ টাকা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "এখানে যখন সেতু ভেঙেছিল তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখে কত ব্যঙ্গ। আমরা দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। তবে মৃতদের পরিবারপিছু একটি করে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।"
মিজোরামের দুর্ঘটনা ঘিরে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এ নিয়ে টুইট করে বলেন, "বাংলায় কর্মসংস্থানের অভাবেই শ্রমিকদের ভিন রাজ্যে গিয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে। মধ্যস্থতাকারীদের মারফত সস্তায় কাজ করতে হচ্ছে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যর্থ পশ্চিমবঙ্গের সরকার।"
১০০ দিনের কাজ
রাজ্য সরকার বারবার অভিযোগ করেছে, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার না মেটানোয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাসীরা কাজ পাচ্ছেন না। এজন্য ভিন রাজ্যে কাজের জন্য তাদের যেতে হচ্ছে। বিরোধীদের বক্তব্য, ১০০ দিনের কাজ কোনো কর্মসংস্থান নয়। এটি কেবল কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়। রাজ্যে কাজ না থাকায় পরিযায়ী হচ্ছেন শ্রমিকরা।
অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু বলেন, "২০-৩০ বছর আগে থেকে শ্রমিকরা অন্য রাজ্যে যান। এটা একটা আর্থসামাজিক প্রক্রিয়া যা দীর্ঘকাল চলছে। ১০০ দিনের কাজে টাকা না পাওয়া তো অল্প দিনের ব্যাপার। তাছাড়া ১০০ দিন কাজ করলে বছরে ২৫ হাজার টাকা একজনের উপার্জন হয়। তাতে কি সংসার চলে?"
অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশের মতে, "১০০ দিনের কাজ থাকলেও বাংলার শ্রমিকরা অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। এই রাজ্যে বিকল্প কাজ মেলে না। সেখানে বেশি মজুরি পাওয়া যায়, কিন্তু ঝুঁকি থাকে। তারই পরিণতি হচ্ছে এই মৃত্যু।"
লকডাউনে দুর্দশা
লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা সামনে এসেছিল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ রাজ্যে ফিরেছিলেন। ফেরার সময় তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়।
পরিযায়ীরা যে একই পরিস্থিতিতে রয়েছেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে মিজোরামের ঘটনায়। প্রসেনজিৎ বলেন, "কেন্দ্রীয় সরকার অমৃতকাল পালন করছে। কিন্তু পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বিপর্যয় বুঝিয়ে দেয় কাজে গাফিলতি আছে। তাই পরিযায়ীদের মৃত্যুর দায় কেন্দ্রীয় সরকারকেও নিতে হবে।"
লকডাউন পর্বে পরিযায়ীদের তালিকা তৈরি করে বিকল্প পরিকল্পনার কথা বলেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু তাতে রাজ্যের বাইরে মানুষের স্রোত রোখা যায়নি। রাজ্য সরকার বিমার কথা বলেছে। পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবার দু'লক্ষ টাকা পাবে। আহতদের ক্ষেত্রে মিলবে ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু নিজের গ্রামে তারা কাজ পাবেন কী করে?
সঙ্কটের সমাধান?
হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ উপার্জনের খোঁজে ভিন রাজ্যে যান। এদের হাতে জমি নেই। গ্রামে কাজ নেই। চাষবাসের কাজ সারা বছর পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তার পারিশ্রমিক যথেষ্ট নয়। তার উপর ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ হচ্ছে না। এর ফলে গভীর সঙ্কটে পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে?
প্রসেনজিৎ বলেন, "রাজ্যে স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, উভয়ই চাই। গ্রামীণ স্তরে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগকে উৎসাহ দিতে হবে, যাতে অকৃষিকাজে মানুষ নিযুক্ত হতে পারে।"
ভারী শিল্পের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। রতন খাসনবিশ বলেন, "সিঙ্গুর থেকে টাটা চলে যাওয়ার পর বড় কোনো বেসরকারি সংস্থা এই রাজ্যে কারখানা গড়তে উদ্যোগ দেখাচ্ছে না। রাজ্যের এই ভাবমূর্তির বদল ঘটাতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ কি রাজ্য সরকার নিতে পেরেছে?"