সমুদ্রে স্নান করার সময়ে শরীরে জেলিফিশের ছোঁয়া পেলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ হ্রদের মিঠা পানির মধ্যেও কিন্তু এই প্রজাতির দেখা পাওয়া যায়৷ বিজ্ঞানীরা তাঁদের অসাধারণ জীবনীশক্তির রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন৷
কয়েক সপ্তাহ ধরে দুই গবেষক বাভেরিয়ার হ্রদ ও পুকুরগুলিতে জেলিফিশের বড় ঝাঁকের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করছেন৷ কিন্তু তাঁরা কি সাফল্য পাবেন?
১৮৮০ সালে প্রথম মিঠা পানির জেলিফিশ আবিষ্কৃত হয়৷ লন্ডনে এক শালুক ফুলের জলাধারে তাদের দেখা পাওয়া গিয়েছিল৷ সম্ভবত চীন থেকে সেগুলি ইউরোপের ভুখণ্ডে পৌঁছেছিল৷ তারপর কোনোভাবে জার্মানির জলাশয়েও তাদের আবির্ভাব ঘটে৷
তাদের শরীরের বিষ মানুষের জন্য বিপজ্জনক নয়৷ তাদের শুঁড়ের রোঁয়া মানুষের ত্বক ভেদ করতে পারে না৷ ফলে স্নানের সময় তাদের সংস্পর্শে এলে ভয়ের কোনো কারণ নেই৷ তবে অনেকেই এমন থলথলে প্রাণীকে ঘৃণা করেন৷ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্য তাদের দেখে মুগ্ধ হতে হয়৷ কাটরিন-এর জেলিফিশ ধরার পদ্ধতি সহজ হলেও বেশ কার্যকরও বটে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে আমরা ১০টি জেলিফিশ সংগ্রহ করেছি৷ বড় ঝাঁকের আবির্ভাবের ফলে তাদের খোঁজ পাওয়া সহজ হয়েছে৷ তাছাড়া এগুলি পূর্ণবয়স্ক, আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই৷ ফলে আরো বেশি বংশবৃদ্ধি ঘটবে না৷''
সমুদ্রসুন্দরী জেলিফিশ
জেলিফিশের বেশ দুর্নাম আছে৷ বেশিরভাগ মানুষই একে ঘেন্না করেন, অনেকে আবার ভয়ও পান৷ কিন্তু এই সামুদ্রিক জীবটি আসলে ভয়ঙ্কর সুন্দর৷ এবং সাগরজুড়ে ভেসে বেড়াতে তাদের মস্তিষ্কেরও প্রয়োজন পড়ে না৷
ছবি: Stefan Ebersberger
মস্তিষ্কই নেই? তাতে কি!
প্রায় ৫০ কোটি বছর ধরে সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে জেলিফিশ৷ কোথায় যাচ্ছে, কোনদিকে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য যে বুদ্ধিটুকু থাকা দরকার, তাও নেই তাদের৷ থাকবেই বা কিভাবে? বুদ্ধির জন্য মস্তিষ্ক তো থাকতে হবে! জেলিফিশের তাও নেই৷ তবে তাদের জটিল স্নায়ুতন্ত্র মস্তিষ্ক ছাড়াই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
সাগরের মেডুসা
গ্রিক পুরাণের এক পিশাচির নাম মেডুসা, চুলের বদলে যার মাথা ভর্তি সাপ৷ জেলিফিশও দেখতে অনেকটা সেরকম৷ মূল শরীর থেকে কিলিবিল করে বের হয়ে এসেছে সাপের মতো কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ৷ এজন্য তাদের বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে মেডুসোজোয়া৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Heimken
হাত-পাওয়ালা ছাতা
আমরা অনেকেই জানি যে, মানুষের শরীরের ৬৩ শতাংশ পানি৷ এবার চিন্তা করে দেখুন, একটা জেলিফিশের শরীরের ৯৯ শতাংশই পানি৷ তাদের শরীরের একটা বড় অংশ দেখতে ছাতার মতো৷ এর সাথে থাকে হাত-পায়ের মতো শত শত কর্ষিকা৷ কিছু কিছু জেলিফিশের ক্ষেত্রে এই কর্ষিকাগুলো কয়েক মিটার লম্বা হয়ে থাকে৷ শিকার ও খাবার আহরণের জন্য জেলিফিশ এই কর্ষিকাগুলো ব্যবহার করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Zankl
এই মাছ, মাছ নয়
নাম জেলিফিশ হলেও, এরা কিন্তু মোটেও ফিশ বা মাছ নয়৷ জীববিজ্ঞানিরা তাদের বিশ্লেষণ করে অন্তর্ভূক্ত করেছেন স্নিডারিয়া পর্বে৷ এই পর্বের অন্যান্য জীবদের মধ্যে আছে প্রবাল এবং এনেমোন নামের এক ধরনের সামুদ্রিক শিকারি ফুল৷
ছবি: picture-alliance/Geisler-Fotopress
দৈত্যাকার জেলিফিশ
বেশিরভাগ জেলিফিশই সাদা এবং স্বচ্ছ হয়৷ কিন্তু আছে কিছু ব্যতিক্রমও৷ এশিয়ান নমুরা জেলিফিশ খুব একটা রঙচঙে না হলেও, আকারে হয়ে থাকে বিশাল৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২ মিটার ব্যাসের এক একটি জেলিফিশের ওজন ২০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে৷
সবসময় সমুদ্রের স্রোতের সাথে ভেসে চলায় বিজ্ঞানীরা জেলিফিশকে প্ল্যাঙ্কটন হিসেবেই বিবেচনা করেন৷ নিজে থেকে কোথাও যাওয়া জেলিফিশের কাজ না৷ মাঝে মাঝে অবশ্য ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে পারে জেলিফিশ৷ তবে যে কোনো ছোট আকারের পোকাও এর চেয়ে জোরে হাঁটতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
বিষাক্ত সুন্দরী
জলে ভেসে বেড়ানোর সময় রঙিন জেলিফিশকে দেখতে অসাধারণই লাগে৷ কিন্তু এদের অনেকেরই আছে ভয়ঙ্কর কর্ষিকা৷ ছবির লায়নস মেইন জেলিফিশ কর্ষিকা দিয়ে বিষ ঢুকিয়ে শিকারকে মেরেও ফেলতে পারে৷ প্ল্যাঙ্কটন, শ্যাওলা, ছোট ছোট কাঁকড়া এবং মাছের পোনা আছে জেলিফিশের খাবারের তালিকায়৷
ছবি: cc-by-sa/Kip Evans
আগুনের মতো জ্বলুনি
লায়নস মেইন জেলিফিশের সংস্পর্শে মানুষের চামড়ায় আগুনের মতো জ্বলুনি হয়৷ লাল লাল ফোসকাও পড়ে চামড়ায়৷ এই জেলিফিশের বিষ অবশ্য প্রাণঘাতী না৷ কিন্তু বক্স জেলিফিশ বা সি ওয়াসপ জেলিফিশের ক্ষেত্রে তা এতটা জোর দিয়ে বলা যায় না৷ প্রাণিজগতে সবচেয়ে বিষধরদের একটি এই জেলিফিশ৷
ছবি: picture-alliance/R. Wilms
স্পেশাল ইফেক্ট
সামান্য এই জেলিফিশেরও আছে অসামান্য ক্ষমতা৷ পেলাগিয়া নকটিলুকা নামের এক ধরনের জেলিফিশ সাগর উত্তাল হলে উজ্জ্বল আলো ছড়ায়৷ এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্স৷ অসাধারণ, তাই না?
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/H. Goethel
জেলিফিশও ঘুমায়!
জেলিফিশের কোনো মস্তিষ্ক নেই, নেই কোনো হৃদয়ও৷ কিন্তু তারপরও তারা ঘুমায়৷ অবাক কাণ্ড না? বিজ্ঞানীরা বলছেন ছবির এই ক্যাসিওপিয়া নামের জেলিফিশটি দিনের বেশিরভাগ সময়ই সাগরের তলদেশে কাটায়৷ রাতের সময়টা তারা ঘুমিয়ে কাটায় বলেও জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷ এমনকি মানুষের মতোই তাদের জেগে উঠতেও সময় লাগে বেশ কিছুক্ষণ৷
ছবি: Caltech
10 ছবি1 | 10
মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোয়াটিক ইকোলজি বিভাগে এই জেলিফিশগুলি পরীক্ষা করা হবে৷ তাদের জিনগত গঠনের পাশাপাশি হ্রদের খাদ্য শৃঙ্খলে তাদের অস্তিত্বের প্রভাবও খতিয়ে দেখা হবে৷ বিভাগীয় প্রধান হেয়ারভিশ স্টিবর এই উদ্যোগ নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী৷ তিনি বলেন,‘‘জেলিফিশ আসলে অসাধারণ প্রাণী, কারণ, তারা পৃথিবীরপ্রাচীনতম বহুকোষী প্রাণীগুলির মধ্যে পড়ে৷ অর্থাৎ, তাদের বেঁচে থাকার কৌশল অত্যন্ত কার্যকরী৷ সেই কৌশল পরীক্ষা করে বুঝতে পারলে বিবর্তনের ক্ষেত্রে সফল ও স্থিতিশীল জীবদের সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে৷''
গবেষকরা হ্রদের মধ্যে জেলিফিশের পরিবেশ সম্পর্কে আরো জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করছেন৷ জেলিফিশের শরীরের প্রায় ৯৯ শতাংশই আসলে পানি৷ জীববিজ্ঞানীরা তাদের রহস্য এখনো ভেদ করতে পারছেন না৷
জেলিফিশের সম্প্রসারণের পথ ও তাদের জেনেটিক গঠন সম্পর্কে আরো জানতে গবেষকরা হ্রদের পানির নীচে পাথরও সংগ্রহ করছেন৷ সেগুলির উপর ক্ষুদ্র অ্যাডেনয়েড পাওয়া যায়, যা আসলে জেলিফিশের আগের অবস্থা৷ জেলিফিশের এই আদি রূপের আকার এক মিলিমটারেরও কম৷ শুধু মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমেই তা দেখা যায়৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং জেলিফিশের দাপট বাড়ছে৷ তারা বিশাল পরিমাণ প্ল্যাংকটন খেয়ে ফেলছে৷ ফলে শেষে অ্যালজি বা জলজ উদ্ভিদের সুবিধা হচ্ছে৷ কারণ, এতদিন প্ল্যাংকটনই তাদের খেয়ে ফেলতো৷
কাটরিন শাখটেলের জন্য এমন এক পরিস্থিতি হ্রদগুলির ইকোসিস্টেমের উপর প্রভাবের একাধিক সম্ভাবনার অন্যতম৷ কারণ, এখনো এই প্রাণী সম্পর্কে অনেক কিছু জানা বাকি রয়েছে৷