বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়মিত হয় না। এর কারণ, প্রভাব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান নির্বাচনি প্রচার নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক মাহবুব কামাল।
কলেজে নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু এটা না হলে পৃথিবী উল্টে যাবে, না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে, এটার উপর জাতির সবকিছু নির্ভর করছে, এই ধরনের আচরণ করা যাবে না।ছবি: Saad Abdullah/DW
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত নির্বাচন করা কেন সম্ভব হয় না?
মাহবুব কামাল : আগে যেটা হয়েছে, ধরেন আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন কেন হয়নি? আওয়ামী লীগ দেখেছে, ডাকসুর ভিপি যিনি হবেন, তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্যারালাল হয়ে যাবেন, সুতারাং এটা করা যাবে না। বিএনপির আমলে হয়নি কেন? ডাকসুর ভিপি যদি অন্য সংগঠন থেকে কেউ হয়ে যান, তিনি তারেক রহমানের প্যারালাল হয়ে যাবেন। সুতারাং এইটা করা যাবে না। ডাকসুর ভিপি একটা বড় ব্যাপার। নিজের দলের বাইরে অন্য কেউ হয়ে গেলে সেইটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সুতারাং তারা এটা করেনি। এখন তো আর কোনো দলীয় সরকার নেই, ফলে এখন হচ্ছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কতটা প্রভাব পড়ে জাতীয় রাজনীতির?
আমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের পক্ষে। তবে আমি চাই, যেসব সংগঠনের প্যারেন্ট অর্গ্যানাইজেশন আছে, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। একটা নির্বাচিত প্রতিনিধি গ্রুপ থাকতে হবে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে বার্গেইন করবে। পাশাপাশি ছাত্রদের অন্যান্য যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু আমরা যেটা দেখছি, আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ, বিএনপির ছাত্রদলসহ অন্যরা নির্বাচন করছে। তখন পুরো জিনিসটা রাজনীতিকরণ হয়ে যায়। এই কারণে ছাত্রদের যে সত্যিকারের সমস্যা, সেগুলোর কোনো সমাধান হয় না। বিশ্বের বহু জায়গায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র প্রতিনিধি আছে, কিন্তু তারা রাজনীতিকরণের মধ্যে না। তারা ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে কথা বলে। ছাত্রদের রাজনীতি কতগুলো প্রেক্ষাপটে জরুরি। যেমন, ধরেন, দেশটা যদি কলোনি হয়, তখন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ছাত্ররা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নামতে পারে। পাকিস্তান আমলে আমরা ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখেছি। আবার ওই দেশটাতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তখন ছাত্ররা গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য রাজনীতি করতে পারে, যেটা আমরা নব্বইয়ের দশকে আমানউল্লাহ আমানদের নেতৃত্বে হতে দেখেছি। আরেকটা হতে পারে, যেমনটা আসামে হয়েছে। যেখানে সুশীল সমাজ নেই, অ্যাকাডেমিশিয়ান নেই, বুদ্ধিজীবী নেই, রাজনৈতিক সংগঠন তেমন শক্তিশালী না, সেখানে এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছাত্ররা রাজনীতি করে। সেখানে প্রফুল্ল মাহান্তের নেতৃত্বে রাজনীতি হয়েছে এবং পরে তিনি মূখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। আরেকটা হতে পারে ছাত্ররা অরাজনৈতিক কোনো আন্দোলন করে। যেমন. পরিবেশবাদী আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন- এমন হতে পারে। আরেকটা হতে পারে ছাত্রদের উপর যদি কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা রাজনীতি করতে পারে। এটা কোরিয়াতে আমরা দেখেছি। ছাত্রদের যখন মিলিটারিতে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে, তখন তারা প্রতিবাদ করেছে। আমাদের এখানে তো এর কোনোটাই নেই। ফলে, এখানে তোছাত্র রাজনীতির কোনো দরকার নেই। আমি মনে করি, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে এবং এই নির্বাচিত ফোরাম বার্গেইন এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের কোনো সংকট দেখা দিলে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এখন যেভাবে হচ্ছে সেটা ঠিক না। সব ছাত্র যদি রাজনীতি করে, তাহলে তারা লেখাপড়া করবে কখন? ৫ আগস্টের পর লেখাপড়াটা ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা কি আমাদের জাতির জন্য ঠিক হচ্ছে?
শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের কথা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন নির্বাচন হয় না? বাধা কোথায়? কলেজগুলোতেও কি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত না? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ছবি: DW
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই নিয়মিত নির্বাচন হয় না : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে সরকার-বিরোধীরাই অধিকাংশ সময় নির্বাচিত হয়। ফলে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়। এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে চায় না।
ছবি: DW
আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো : রিফাত জাহান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবার আগে আমি আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো, যার কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা নেই এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হবে না। প্রার্থীর কাছে আমি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাবি করতে পারি, তবে অবশ্যই সেটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চাই না : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডাকসু ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। তবে বাস্তবে এটি প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে৷ ফলে, প্রশ্ন ওঠে- ডাকসু কি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করছে, নাকি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছে? অবশ্য ডাকসুর প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হন, তবু তারা সাধারণত নিজেদের রাজনৈতিক দলের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকেন। এমন লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চাই না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচনে নারী প্রার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই নেতৃত্বে সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা না গেলে গণতান্ত্রিক চর্চা পূর্ণতা পায় না। তাই নারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য : পপি রাজবংশী, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। ছাত্র সংসদে বিভিন্ন পদে কিছু নারী শিক্ষার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও তাদের অবস্থান ভালো না। আবার হল সংসদে অনেক পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। সব মিলিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণও সন্তোষজনক নয়। রাকসুতে ‘জাতিসত্ত্বা বিষয়ক সম্পাদক’ পদের সংযুক্তিসহ চার দফা দাবি জানিয়েছিল ‘আদিবাসী’ ছাত্র সংগঠনগুলো। এ দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতদের দায়িত্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা : নাঈম ইবনে জামান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি যাদের ভোট দিবো, তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ না হওয়ায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক যেসব অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যেমন, একাডেমিক সিলেবাসকে যুগোপযোগী করা, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ফান্ডিং ও স্কলারশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর অগ্রাধিকার শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং দলীয় স্বার্থই হবে - এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত। যখন ছাত্র সংসদ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, তখন তারা জাতীয় স্বার্থে বড় ভূমিকা রেখেছে। দলীয় রাজনীতির অতীত ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, ছাত্র সংসদে দলীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শকে হেজেমোনিক করে তুলবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতরা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন : সাদিয়া শরিফ শান্তা, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। কিন্তু যদি পূর্ণ প্যানেল বা অধিকাংশ পদে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীরাই জয়ী হন, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সৎ ও মেরুদণ্ড থাকা নেতা চাই : মামুন ইসলাম, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নেতার হতে হবে স্বচ্ছ, তার মধ্যে অবশ্যই কোনো প্রকার দ্বিচারিতা, কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কাজ করার মানসিকতা থাকতে পারবে না। প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো সৎ সাহস এবং ডিসিশন মেইকিংয়ের যোগ্যতা, তথা মেরুদণ্ড থাকা একান্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা জরুরি : অর্পিতা সুশীল অপি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নির্বাচনে অমুসলিম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত জরুরি। এটি বৈষম্য রোধ, সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা ও চাহিদা তুলে ধরতে সহায়ক হবে। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব যতটা বেশি উঠে আসবে, শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ছাত্র সংসদ গঠনে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্যাম্পাসে শান্তি ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : বোরহান রব্বানী, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমরা তেমন কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দেবো না। আমরা বিবেচনা করবো-কে বা কারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা শিক্ষার্থীদের নায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। এছাড়া যাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসের শান্তি, উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- তাদেরই আমরা ভোট দেবো।
জাকসু নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম থাকার অন্যতম কারণ হলো- রাজনীতির পরিবেশকে এখনো অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। কেননা, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের অনলাইন বুলিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব এবং নেতৃত্বে নারীদের সুযোগ কম থাকায় অনেকেই এগিয়ে আসতে চান না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
12 ছবি1 | 12
লেজুরবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আলোচনা হলেও এখনো তো দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেই তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো প্যানেল দিচ্ছে৷ তাহলে লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি কিভাবে বন্ধ হবে?
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতি করা তো সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। কাউকে তো বলা যাবে না, তুমি রাজনীতি করতে পারবে না। ফলে রাজনীতিকে বাধা দেওয়ার সাংবিধানিক কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমাদের শুভবুদ্ধি দিয়ে এই চিন্তাকে পূর্নগঠিত করতে হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে, ‘‘আমরা কোনো ছাত্র সংগঠনের প্যারেন্ট না, যেটা এরশাদ করেছিল। তিনি কিন্তু ছাত্র সমাজকে অস্বীকার করেছিলেন। ছাত্ররা সংগঠন করবে তাদের নিজস্ব চিন্তা দিয়ে। এখন ছাত্রলীগ বসে থাকবে শেখ হাসিনা কী নির্দেশ দিচ্ছেন, ছাত্রদল বসে থাকবে তারেক রহমান কী নির্দেশ দিচ্ছেন? তাহলে তো ছাত্রদের স্বাধীন স্বত্ত্বা থাকছে না। এটা তো ছাত্র সমাজের জন্য অগৌরবের।
রাজনৈতিক দলের স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের মধ্যে কখনো সংঘাত তৈরি হলে রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি কি শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিতে পারবে?
না, কখনোই নিতে পারবে না। ধরেন, কথার কথা- এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে ভিপি বা জিএস বা ভিপি ও জিএস দু'টি পদেই তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন। তাহলে তারা কার দ্বারা পরিচালিত হবেন? তিনি পরিচালিত হবেন তারেক রহমান দ্বারা। তারেক রহমান যেটা বলবেন, তারা সেটাই করবেন। অর্থাৎ, তারা দলীয় পারপাস সার্ভ করবেন। ছাত্রদের সমস্যা তার কাছে গৌণ হয়ে যাবে। ছাত্রদের কোনো দাবির প্রতি যদি তারেক রহমান একমত পোষণ না করেন, তাহলে তিনি ভিপি-জিএসকে বলে দেবেন যে, তোমরা এটা নিয়ে মাথা ঘামাইও না। ব্যাস সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কী ধরনের নেতা নির্বাচিত হওয়া উচিত?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো গ্রামাঞ্চল থেকে অনেক ছাত্র আসে। তারাই ৯০ শতাংশ। এরা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে এখানে আসে। তাদের তো গ্লোবাল দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। থাকার কথাও না। ডাকসুতে এমন প্রতিনিধি থাকতে হবে, যাদের এদেরকে আধুনিক করে গড়ে তোলার যোগ্যতা থাকবে। তাদের এমন ম্যানেজারিয়াল ক্যাপাসিটি থাকতে হবে, যাতে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বার্গেইন করে দাবি আদায় করতে পারেন, সংকটগুলো দূর করতে পারেন। তাদের রাজনৈতিক মনন থাকতে হবে, তবে সেটা দলীয় না।
আমি ১৯৭৯-৮০ সালের ডাকসুতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। তখন আমরা কালচারাল উইং করেছি, ডিবেট করেছি। এগুলো করার জন্য তো সাংস্কৃতিক মনন লাগবে। আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, যার হাতে থাকে একটা রাজনীতির বই, আরেক হাতে থাকে একটা কবিতার বই, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। এখন আমাদের ছাত্রদের হাতে আছে রাজনীতির বই, কিন্তু অন্য হাত তো খালি। সেখানে কিছু নেই। সেখানে একটা কবিতার বই রাখো। তখন তো সংস্কৃতি ও রাজনীতি মিলে চমৎকার একটা জিনিস হতে পারে। সবাই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। এই নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত।
ছবি: Abdul Goni
বাকের মজুমদার (আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী হল প্রশাসনের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হলে ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। এখানে লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার্থীরা কি চায়? তারা একমত যে, হলে তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের পক্ষে, তাদের চাওয়াই আমাদের চাওয়া। আমরা হলে যেমন ওপেন রাজনীতির বিরোধিতা করছি, তেমনি গুপ্ত রাজনীতির যে কথা শুনতে পাই, সেটাও বন্ধ হওয়া উচিৎ।
ছবি: Samir Kumar De/DW
নুজিয়া হাসিন রাশা (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট - জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করার, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার কৌশল। রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ মূলত গুপ্ত সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠী, কর্পোরেট এনজিও ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে, যা জনগণের গণতান্ত্রিক স্পেসকে সংকীর্ণ করে। প্রতিরোধের রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না, হয় তা প্রকাশ্যে থাকে নয়তো তা গুপ্ত পথ নেয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ, প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে গুপ্তপন্থাকে প্রণোদনা দেওয়া। এহেন পদক্ষেপ অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে দেয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরমানুল হক (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আমি যখন হলে অবস্থান করব, তখন তো আমার পরিচয়কে লুকাতে পারি না! হলে ছাত্র রাজনীতি সমস্যা, নাকি হলের দখলদারিত্ব সমস্যা? হলে যদি ১ম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কীভাবে একটা নির্দিষ্ট দল দখল করতে পারে? আর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হল সংসদকে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া ভিন্ন কোন ফোরাম আছে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন।
ছবি: Samir Kumar De/DW
আশরেফা খাতুন (মুখপাত্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, হলে নিয়োজিত হাউজ টিউটররাও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গণরুম, গেস্টরুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন নাই। হলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কমিটি দেওয়া শুরু হলে আবারও এক চিত্রের আবির্ভাব ঘটবে। আমি চাই, আবাসিক হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিনিধিত্ব করুক যাতে দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুমের বিভীষিকা ফিরে না আসে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নাহিদুজ্জামান শিপন (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত ঘটে হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। হলে রাজনীতি বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে অর্থবহ করা যাবে না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
এস এম সাইফ কাদের রুবাব (মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা আদতে ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণে আসবে না।
ছবি: Samir Kumar De/DW
জাহিদুল ইসলাম তাহসিন (শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ক্যাম্পাসের বড় সমস্যাগুলোর একটি সিট সংকট, আর হলে রাজনীতি ফিরে এলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেতারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। একই সঙ্গে হলে একক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এর ফলে হলের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে এবং পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মারুফ হাসান শাহিন (শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হলে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আগের মতো গণরুম প্রথা ফিরে আসতে পারে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকার দলের রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। একইভাবে পরিচয় পর্ব ও ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম প্রথাও আবার শুরু হতে পারে। দলীয় কোন্দল বেড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
9 ছবি1 | 9
এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কলেজগুলোতেও কি এই ধরনের নির্বাচন হওয়া উচিত না?
কলেজগুলোতে না হওয়াই ভালো। তারপরও হতে পারে। আমাদের মিডিয়া ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যে হাইপ তুলেছে, মনে হচ্ছে এটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়েও বড় কিছু। এত তো দরকার নেই। একটা নির্বাচন হচ্ছে, তো হচ্ছে। যেভাবে এটাকে ওভার-প্লে করা হচ্ছে, সেটা ঠিক না। মিডিয়া তো মানুষের মনস্তত্ত্ব পুনর্গঠন করে। এখন মিডিয়া যদি ঠিকমতো রোলটা প্লে না করে, কোন ট্রিটমেন্টটা কোথায় কতটুকু দিতে হবে সেটা যদি না বোঝে, তাহলে তো সবার মতো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলাম। ফলে কলেজে নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু এটা না হলে পৃথিবী উল্টে যাবে, না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে, এটার উপর জাতির সবকিছু নির্ভর করছে, এই ধরনের আচরণ করা যাবে না।
‘যেখানে সুশীল সমাজ নেই, রাজনৈতিক সংগঠন তেমন শক্তিশালী না, সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছাত্ররা রাজনীতি করে’: মাহবুব কামাল
This browser does not support the audio element.
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকলে জাতীয় রাজনীতিতে কি কোনো প্রভাব পড়ে?
খুব যে প্রভাব পড়ে তা কিন্তু না। দেখেন, ১৯৯১ সালের পর ২০-২৫ বছর ডাকসু হয়নি, তাতে কি রাজনীতি বন্ধ ছিল? সব ডাকসু রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তা কিন্তু না। আমাদের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে কোন কোন ডাকসু? একটা ১৯৬৯ সালের ডাকসু, ১৯৭০ সালের ডাকসু এবং ১৯৯০ সালের ডাকসু। একটা তোফায়েল আহমেদের ডাকসু, একটা আ স ম আব্দুর রবের ডাকসু এবং একটা আমানউল্লাহ আমানের ডাকসু। বাকি ডাকসু বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। যেমন, ১৯৭৯ বা ৮০ বা ৮১ সালের ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ছিল। এখন আমরা যদি ধরে নেই, ডাকসু হচ্ছে সেকেন্ড পার্লামেন্ট, ডাকসু হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা তৈরির সাপ্লাই লাইন- এটা আমাদের গ্লোরিফাই করা। এখন বড় ধরনের যদি সংকট থাকে, তাহলে, যেমন ধরেন, ১৯৬৯ বা ৭০ সালে আমাদের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিল। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল। স্থিতিশীল অবস্থায় ডাকসুর বড় কোনো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না।
ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি বন্ধ থাকে, তাহলে কাদের লাভ হয়?
ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক মনন যদি আপনি বন্ধ করে রাখেন, তাহলে তো জাতির ক্ষতি হবেই। আমার কথা হচ্ছে, ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক মানস থাকবে, কিন্তু লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি থাকা উচিত না। জাতির বড় ধরনের সংকটে তারা ভুমিকা রাখবে।