পশু-পাখির বুদ্ধি
২০ মার্চ ২০১২‘কানাই মাস্টারের' ছাত্রটা যে লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী ছিল না, সেটা আমরা শৈশবেই জেনে গেছি৷ রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, যতোই তাকে ‘ক খ গ ঘ ঙ' পড়ানো হোক, সে কেবলই বলতো ‘মিঞ মিঞ মিঞ'!
কিন্তু এ তো গেল হ য় ব র ল'এর বেড়াল ছানার কথা৷ বিশ্বে এরকম বহু পশু-পাখি আছে, যাদের বুদ্ধি অনেকক্ষেত্রেই চমকে দেয়ার মতো৷ এই যেমন শিম্পাঞ্জিরা৷ সম্প্রতি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রমাণ করলেন যে, বচসা এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে বরাবরই একজন ‘মিডিয়েটর' বা মধ্যস্থতাকারীর ব্যবহার করে এসেছে এরা৷ বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘প্লোস ওয়ান'-এ বেরিয়েছে এ তথ্য৷ সত্যি, প্রাণী জগতে ‘কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট'-এর এহেন আধুনিক পন্থা বড় একটা দেখা যায় না৷
অথচ এতোদিন, অবহেলাই জুটেছিল শিম্পাঞ্জিদের কপালে৷ এ যাবত বৈজ্ঞানিক কুল কিছুতেই মানতে চান নি যে, ব্যবহারিক বিজ্ঞানে এদেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে৷ কিন্তু, নৃতত্ত্ববিদ কারেল ফন শাইক এবং ক্লাউডিয়া রুডল্ফ ফন রোয়র'এর সাম্প্রতিকতম গবেষণায় ধরা পড়েছে সেটাই৷
তাঁরা নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১১টি শিম্পাঞ্জির ওপর পরীক্ষাটা চালান৷ সেই দলে প্রাথমিকভাবে দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা, একজন তরুণ এবং দুটি তরুণী শিম্পাঞ্জি ছিল৷ কিন্তু, ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ দলে আরো তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী শিম্পাঞ্জির প্রবেশ ঘটলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে৷ দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে কে দলের প্রধান হবে এবং কে কোন নারীকে ভোগ করবে – এ নিয়ে শুরু হয়ে যায় কলহ, বচসা৷
অবাক করার মতো বিষয়, কিছু দিন ঐ ঝগড়া চলার পর, সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে জ্যেষ্ঠ শিম্পাঞ্জিটি৷ অনেকটা পারিবারিক সমস্যা সমাধানের মতো বিষয়৷ বিজ্ঞানীরা দেখান, প্রায় ৬৯টি এ ধরণের বচসায় ‘মিডিয়েশন মেকানিজম' কাজে লাগিয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷ অবিশ্বাস্য হলেও, এর প্রায় ৬০টি ক্ষেত্রেই ঐ মধ্যস্থতায় কাজও হয়৷
কারেল ফন শাইক এবং ক্লাউডিয়া রুডল্ফ ফন রোয়র জানান, শিম্পাঞ্জি আর মানুষের ডিএনএ'র মধ্যে নাকি অন্তত ৯৯ শতাংশ মিল রয়েছে৷ অর্থাৎ, পার্থক্যটা শুধুমাত্র ‘জাঙ্ক' ডিএনএ'র মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বলেন তাঁরা৷ আসলে পশু-পাখির বুদ্ধি কতো? - এ নিয়ে আগেও গবেষণা হয়েছে৷ তবে এবারের গবেষণায় যে প্রাপ্তি, সেটা ভিন্নতর৷
এই প্রথম বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশু-পাখির বুদ্ধি চমকে দেয়ার মতো৷ এই তো কিছুদিন আগে, ওয়াশিংটন'এর এক চিড়িয়াখানার একটা এশীয় হাতির সামনে একটা আয়না বাড়িয়ে দেন বিজ্ঞানীরা৷ প্রথমে হাতিটা তেমন আগ্রহই দেখায়নি৷ কিন্তু পরে তার ভেতর একটা হাতি দেখে কৌতূহল হয় তার৷ আয়নাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে বুঝে নেয় যে, আয়নার ভেতর যা দেখা যাচ্ছে, সেটা আসলে তারই প্রতিবিম্ব৷
মানুষের বোধের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, সে অন্যের মানসিক অবস্থা, বিশেষ করে অন্যের জ্ঞান এবং বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করতে পারে৷ এতোদিন ধারণা করা হতো, অন্যের সম্পর্কে বুঝতে পারার এই ক্ষমতা কেবল মানুষেরই আছে৷
কিন্তু এবার, বিভিন্ন প্রাণীর ওপর পরিচালিত মনস্তত্ত্ব পরীক্ষা অন্য কথা বলছে৷ শিম্পাঞ্জি সহ কিছু অমানব প্রাইমেট অন্যের অভিপ্রায় বুঝতে পারে এবং অন্যরা কি দেখছে বা কি দেখছে না – তাও অনুমান করতে পারে৷
এক্ষেত্রেও যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট অ্যান্ড্রুস, উগান্ডার বুডোংগো কনজার্ভেশন ফিল্ড স্টেশন এবং জার্মানির মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর ইভল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি-র গবেষকরা দেখান, পথে চলার সময় হঠাৎ কোনো সাপ দেখতে পেলে, শিম্পাঞ্জিরা শব্দ করে অন্যদের সাবধান করে দেয়৷ শুধু তাই নয়, তার আশপাশের শিম্পাঞ্জিরাও যদি সাপটি দেখতে পায়, তাহলে সে বেশি শব্দ করে না৷ কিন্তু অন্য কেউ না দেখলে, অপেক্ষাকৃত জোরের সঙ্গে অন্যদের সাবধান করে দেয় সে৷
যেমন, প্রকৃত সাপের পরিবর্তে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন প্লাস্টিক ভাইপার৷ এরপর, শিম্পাঞ্জিরা যে পথ দিয়ে চলাচল করে সেই পথে রেখে দেন ভাইপারটি৷ দেখা যায়, যখন ভাইপারটি সবার সামনে ছিল, তখন কেউ খুব একটা উচ্চবাচ্য করে নি৷ অথচ ভাইপারটি কিছু পাতা দিয়ে আড়াল করা পর, জিনিসটি যে'ই প্রথমে দেখেছে, সে'ই শব্দ করে অন্যদের সাবধান করে দিয়েছে৷
এ থেকেই বোঝা যায় যে, শিম্পাঞ্জিরাও অন্য শিম্পাঞ্জিদের জানা-অজানার পরিসীমা সম্পর্কে একটা ধারণা রাখে৷
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন