প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে মিথ্যা মামলার যেন ‘জুড়ি' নেই। ভারতে রাজনীতি থেকে সমাজ সর্বত্রই মিথ্যা মামলার অভিযোগ আছে।
বিজ্ঞাপন
গত ১৯ মার্চ দিল্লির ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক জগমোহন সিং এক নারীর দুই মাস কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। সেই নারীর অপরাধ হলো, তিনি ধর্ষিতা হয়েছেন বলে মিথ্যা মামলা করেছিলেন চারজনের বিরুদ্ধে।
সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারক বলেছিলেন, ধর্ষণের নাম করে মিথ্যা মামলার সংখ্যা সমানে বাড়ছে। তাই ওই নারী মিথ্যা অভিযোগ করেছেন দেখে তিনি দুই মাসের কারাদণ্ডের শাস্তি দিচ্ছেন, যাতে অন্যরা এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন।
বিচারক জগমোহন সেই সঙ্গে বলেছিলেন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ নিয়ে মিথ্যা মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর ফলে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, তিনি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ছেন, অন্যদিকে যেখানে ধর্ষণ হয়েছে, সেখানে বিচার হতে দেরি হচ্ছে।
তিনি এটাও বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে মর্যাদাকে মানুষ এখনো খুব বেশি গুরুত্ব দেয়। একবার তা চলে গেলে, সেটা আর ফিরে আসে না।'' ওই মামলায় অভিযুক্তরা সকলে জামিন পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মিথ্যা মামলার ফলে তারা যে কষ্টের মধ্যে পড়েছেন, তা বলে বোঝানো যায় না। বিচারক এই কথাগুলো ধর্ষণ সংক্রান্ত মিথ্যা মামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কিন্তু যে কোনো ধরনের মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।
মাদ্রাজ হাইকোর্ট এরকমই একটা কাজ করেছিল। এক তাইকোন্ডো প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে তারই কয়েকজন ছাত্রীকে দিয়ে নারী নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করে মিথ্যা মামলা করিয়েছিল দুই ব্যক্তি। অত্যন্ত কড়া পকসো আইনে তার বিচার শুরু হওয়ার পর মাত্রাজ হাইকোর্ট প্রশিক্ষককে অভিযোগমুক্ত ঘোষণা করে, ওই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পকসো আইনেই মামলা শুরু করার নির্দেশ দেয়।
আমরা সাধারণত বলে থাকি, একজন যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত তাকে কোনোভাবেই অপরাধী বলে মানা হয় না। তাকে শুধু অভিযুক্তই বলতে হবে। আবার কেউ এইভাবে অভিযুক্ত হওয়ার পর এটাও বলা হয়, যা রটে, তা কিছুটা তো ঘটেই। দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটতে দেখেছি। কেজরিওয়ালকে যখন প্রথম গ্রেপ্তার করা হলো, তখন অনেকেই মনে করছিলেন, এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আবার সেই কেজরিওয়াল যখন জামিন পাচ্ছেন না, মাসের পর মাস জেলে থাকছেন, তখন তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পিছনে কিছুটা সত্যতা নিশ্চয়ই আছে, না হলে কি তাকে এইভাবে দিনের পর দিন জেলে বন্দি করে রাখা যায়?
তাই মামলা যে বিষয়েই হোক না কেন, ধর্ষণ, দুর্নীতি থেকে শুরু করে যে কোনো বিষয়েই মিথ্যা মামলা করা হোক না কেন, সেটা সবসময়ই ভয়ংকর। অভিযুক্তদের তার জন্য যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তা মর্মান্তিক। দিল্লিতে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করার জন্য ওই নারীর না হয় দুই মাস জেল হয়েছে, অন্যত্র মিথ্যা মামলা করার জন্য কারো, বিশেষ করে পুলিশের কোনো জেল হয় কি?
ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে গুচ্ছের মামলা করা হয়। বিশেষ করে যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন, মিছিল করেন, জনতার সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, কর্মরত অবস্থায় সরকারি কর্মীদের গায়ে হাত তোলা, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ-সহ অজস্র অভিযোগ থাকে। সেই সব মামলা চলতেই থাকে। তারা যখন নির্বাচনে দাঁড়ান, তখন সেই খতিয়ান দিতে হয়। সেসময় যখন বলা হয়, এতজন রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে, তখন রাজনীতিকদের জবাব হলো, এটা তো যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে করবেই।
আদালতে বিচারপ্রার্থীদের যত দুর্ভোগ
আদালত অঙ্গনে গিয়ে বিচারপ্রার্থীদের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছে ডয়চে ভেলে৷ তাদের নানা ধরনের দুর্ভোগের কথা থাকছে ছবিঘরে...
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সন্তানের জন্য মায়ের সংগ্রাম
সাভারের অ্যানি আক্তার তার মেয়ে রাবিয়া বুসরিকে নিয়ে তিন মাসে একবার ঢাকার আদালতে আসেন সন্তানের ভরণপোষণের টাকা নিতে। রাবিয়ার বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আদালতের মাধ্যমে মাসিক তিন হাজার টাকা ভরণপোষণের জন্য নির্ধারিত হলেও সেই টাকা তুলতে ঢাকায় যাতায়াত ও অন্যান্য কাজে প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি টাকায় মেয়ের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অ্যানি। তবুও মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য অ্যানি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Abdul Goni
শারমিনের অভিজ্ঞতা
ঢাকার মিরপুরের শারমিন আক্তার। তার ভাই ইব্রাহিম সরকার পালিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। ইব্রাহিম ও শারমিনের বিরুদ্ধে ওই মেয়েটির বাবা ধর্ষণ মামলা করেছেন। সেই মামলায় শারমিন ছয় মাস জেলও খেটেছেন। একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দেয়ায় তিনি বিস্মিত ও হতাশ৷ ন্যায় বিচারের আশায় তাকে প্রতি মাসেই আদালতে আসতে হয়। শারমিন জানালেন, মামলার পেছনে তার অনেক টাকাও খরচ হয়েছে।
ছবি: Abdul Goni
বিগত সরকারের আমলের মামলার কারণে আদালতে আসা-যাওয়া
কৃষক দলের সদস্য হারুনুর রশিদ সুমন। রাজনীতির কারণে বিগত সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা হয়েছে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর অনেকের মামলা প্রত্যাহার করা হলেও সুমনের মামলাগুলো আগের মতোই আছে। কিভাবে মামলা প্রত্যাহার হবে, কার কাছে যাবেন, কাকে ধরলে কাজ হবে জানেন না তিনি। তারপরও মামলা প্রত্যাহার হবে এমন আশায় প্রতিদিনই আসছেন পুরনো ঢাকার কোর্টে।
ছবি: Abdul Goni
ছেলেকে নিয়ে আদালতে
ছেলে আলামিন শুভর স্ত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ছেলের কারণে গত দুই বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন আব্দুর রাজ্জাক। তার দাবি, স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে শুভর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু শুভর স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা প্রভাবশালী হওয়ায় হত্যা মামলা করেছে। সেই মামলায় জেল খেটেছে শুভ। এখন প্রতিনিয়তই হাজিরা দিতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন আব্দুর রাজ্জাক।
ছবি: Abdul Goni
মামলার নিষ্পত্তিতে ধীর গতি
মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগছে বলে মনে করেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খুরশিদ মিয়া আলম। বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেই গতিতে মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলেই মত তার। তিনি বলেন, লাখ লাখ রাজনৈতিক মামলা ছিল। সেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে কিছু কিছু। কিছু মামলা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। ঘন ঘন জজদের বদলিতেও বিচার কিছুটা বিঘ্ন হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায় বিচার, সুবিচার পেতে সময় লাগছে।
ছবি: Abdul Goni
‘নারী নির্যাতন-মাদকসহ অন্যান্য মামলায় প্রশাসনের নজর কম’
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। তার মতে, ‘‘উল্টো দুর্ভোগ বেড়েছে। রাজনৈতিক মামলার কারণে নারী-মাদকসহ স্বাভাবিক সময়ে যে মামলাগুলো হয়, সেগুলো হচ্ছে না। এসব মামলার দিকে প্রশাসন নজর দিতেও পারছে না। প্রশাসনকে অস্থির মনে হচ্ছে। এই সরকারের আমলে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা ছিল, সেটা পূরণ হচ্ছে না।’’
ছবি: Privat
আদালতেও বৈষম্য
আদালতেও এক ধরনের বৈষম্য হচ্ছে বলে মনে করেন আইনজীবী আমিনুল গনি টিটো। তার মতে, রাজনৈতিক মামলা কিছুটা কমলেও অন্যান্য মামলা আগের মতোই আছে। আদালতে বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবীদের ওপর হামলার ঘটনায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আগে কিন্তু আইনজীবীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি। এই পরিস্থিতিতে আইনজীবীরা আদালতে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন। এভাবে তো আদালত চলতে পারে না।’’
ছবি: Privat
‘সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ আগের মতোই’
আগে জজ সাহেবরা অনেক বেশি চাপে থাকতেন বলে মনে করেন আইনজীবী তরিকুল ইসলাম। এখন জজ সাহেবদের উপর সেই চাপ নেই। পরিস্থিতিতে এক ধরনের ইতিবাচক গতি এসেছে। তবে তিনি মনে করেন, সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ আগের মতোই আছে। এখন একজন বিচারপ্রার্থী এক বছর পর একটি ডেট পান। সেদিনও যদি শুনানি না হয় তাহলে তারা তো হতাশ হবেনই।
ছবি: Privat
ন্যায় বিচারের আশায়
তিন সন্তানকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের পলি আক্তারের এখন দিন কাটছে থানা আর আদালতের বারান্দায়। ন্যায়বিচারের আশায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আদালতেই থাকছেন। তার স্বামী মো. কবির তার দেখাশোনা করে না। কিস্তিতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন পলি। সেই গাড়ি নিয়ে কবির তাকে ছেড়ে চলে যায়। এখন স্বামীর বিচার চেয়ে ঘুরছেন আদালতের দরোজায়।
ছবি: Abdul Goni
9 ছবি1 | 9
এর ফলে জনমানসে একটা ধারণা তৈরি হয়, রাজনীতিকরা এই সব অপরাধ করেন না, অথচ, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। তাতে অনেক সময় গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তারা বেনিফিট অফ ডাউট পেয়ে যান। এই যে ক্ষমতায় এলেই সব দল এই অস্ত্র প্রয়োগ করে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তার ফল তাই সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। মুকুল রায় য়খন তৃণমূল ছাড়লেন, তখন তার বিরুদ্ধে রাশি রাশি মামলা হতে শুরু হলো বলে অভিযোগ উঠেছিল। অর্জুন সিং তৃণমূল থেকে অন্য দলে যাওয়ার পরেও একইভাবে গাদা গাদা মামলা শুরুর অভিযোগ উঠেছে। আবার এর উল্টোটাও সত্যি। বিজেপি-তে কেউ যোগ দিলে তখন তার বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি আর সক্রিয় হয় না বলে অভিযোগ ওঠে। মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীদের ক্ষেত্রেও এই অভিযোগ উঠেছে।
গত ৪ অগাস্টের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট বলছে, ২০১৪ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা ২৫ জন বিরোধী রাজনীতিক বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। তার মধ্যে তিনটি মামলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০টি ক্ষেত্রে তদন্তের কাজ থেমে আছে। বলা হচ্ছে, যদি দরকার হয় তাহলে অ্যাকশন নেয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা বন্ধ করা হয়েছে, তার মধ্যে আছেন অজিত পাওয়ার ও প্রফুল্ল প্যাটেল। বিরোধী দলগুলি হামেশাই অভিযোগ করে , বিজেপি হলো ওয়াশিং মেশিন, একবার সেখানে যোগ দিলেই অভিযোগমুক্তি হয়। তবে এটা শুধু বিজেপি-নয়, ভারতে ক্ষমতাসীন সব দলের ক্ষেত্রেই কমবেশি সত্যি।
আবার বলি, এর ফলটা মারাত্মক হচ্ছে। যখন সত্যি কেউ অপরাধ করেন, তখন সেটাকে লঘু করে দেখার প্রবণতা থাকে। তবে শুধু ধর্ষণ নিয়ে বা বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধেই নয়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগ কমবেশি অনেকের বিরুদ্ধেই ওঠে। তার মধ্যে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিক্ষোভকারী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি সকলেই আছেন।
কলকাতার কাছের একটি জেলার মানুষদের ক্ষেত্রে বলা হয়, তারা হলেন মামলাবাজ। মামলা করাটা তাদের নেশা। তারা ছুতোয়-নাতায় মামলা করেন। এই ধরনের মামলার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে। যার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, তাকে বিপাকে ফেলা। সব ধরনের মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে এই বিপদে ফেলার বিষয়টি থাকে। কেউ প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে, কেউ নিজের বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে, কেউ অন্যকে সবক শেখাতে, কেউ ক্ষমতায় থাকতে, কেউ ক্ষমতায় আসতে এই অস্ত্র ব্যবহার করেন।
প্রকৃত অভিযোগ আর মিথ্য়া মামলার মধ্যে তফাৎ কোথায়? মিথ্যা মামলা হলো সেটাই, যেখানে মিথ্যা তথ্যের সাহায্যে, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। পুলিশের এই যুক্তি থাকতেই পারে যে, তারা কোনো অভিযোগ পেয়েছে, তার ভিত্তিতে তদন্তের ভিত্তিতে রিপোর্ট দিয়েছে। অথবা, কোনো ঘটনা ঘটেছে, তাতে পুলিশ দেখে বা তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যা হলে, পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতে মামলা হলে পুলিশেরও সাজা পাওয়া দরকার। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষেরও সাজা হওয়া উচিত। নাহলে বিচারক জগমোহনের মতো কয়েকজন কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি দেবেন, বাকি ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলা করেও বাকিরা পার পেয়ে যাবেন, তাহলে তো আর যাই হোক, মিথ্যা মামলা ঠেকানো যাবে না।
কলকাতার মানুষ যেভাবে ট্রাফিক ও পরিচ্ছনতার বিধি ভাঙেন
কলকাতার রাস্তায় হামেশাই দেখা যায় ট্রাফিক আইন মানা হচ্ছে না। বাসচালক, পথচারী থেকে শুরু করে সকলেই আইন ভাঙেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
জরিমানার নোটিশ
কলকাতার মানুষ হামেশাই এমন কাজ করেন, শহরের পরিচ্ছনতা, অন্যের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। তারা নিজের অজান্তে অথবা ইচ্ছে করেই কিছু বিধি লঙ্ঘন করেন। নাগরিক আচরণকে সুশৃঙ্খল করতে ‘কর্তৃপক্ষকে’ দেওয়ালে নোটিশ দিয়ে জরিমানার নিদান দিতে হয়। তাতে কি কাজ হয়?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হাসপাতালে গিয়ে মানুষ যা করছেন
‘থুতু ফেললে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হবে’ জানার পরেও কিছু মানুষ পানমশলা, গুটখা চিবিয়ে নিজের চারপাশ এইভাবে নোংরা করে রাখেন। তারা একবারের জন্যও ভাবেন না, এরফলে শুধু দৃশ্যদূষণ হয় না, জায়গাটা শুধু নোংরাই হয় না, তাদের এই কাজ অন্যের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। ওপরের ছবিটি একটি হাসপাতাল চত্বরের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শৌচালয় থাকা সত্ত্বেও
কলকাতা শহরের প্রায় সব জায়গাতেই সুলভ শৌচালয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। তা সত্বেও দেখা যায় বহু মানুষ যত্রতত্র রাস্তাতেই মূত্রত্যাগ করেন। এই অপরাধকে এখনও গৌণ বলেই মনে করা হয় বলেই হয়ত প্রশাসনের তরফ থেকে সেভাবে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। অনেকের মতে সারা শহর জুড়ে শৌচালয়ের পরিকাঠামো সেভাবে গড়ে তুলতে পারেনি প্রশাসন, তাই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই এইসব বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কড়া হতে পারে না সরকার।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হেলমেট নিয়ে
কলকাতা শহরে বাইক আরোহীর হেলমেট না পরার ক্ষেত্রে পুলিশ কড়া মনোভাব দেখালেও স্থান ও কাল হিসেবে তা ঢিলেঢালা থাকে। দেখা গেছে সকালের দিকে পড়ুয়ারা যখন স্কুলে যায় তখন হেলমেট না পরা থাকলেও পুলিশ ‘ক্ষমাশীল’ হয়ে ওঠে। ওপরের ছবিতে এক অভিভাবক বাচ্চাদের বাইকে চাপিয়ে স্কুলে পৌঁছতে যাচ্ছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দ্রুতগতির রাস্তাতেও
ভিআইপি রোডের মত গতিশীল রাস্তাতেও হেলমেট হীন বাইক আরোহী দেখা যায়। ‘স্থানীয় মানুষ’ পরিচয়ে পারও পেয়ে যায় তারা। ছবিটি কলকাতা এয়ারপোর্ট সংলগ্ন ভিআইপি রোডের। একটি বাইকে তিনজন আরোহী, যা শাস্তি যোগ্য অপরাধ এবং তিনজনের মাথাতেই হেলমেট নেই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রক্ষক যেখানে আইনভঙ্গকারী
অনেককেই দেখা যায় পদাধিকার বলে আইন লঙ্ঘন করার একটা ছাড়পত্র নিজেই নিজেকে দিয়ে দেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে খোদ এক পুলিশকর্মী বাইকে আরেকজনকে বিনা হেলমেটে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি পুলশকর্মীর মাথার হেলমেটটিও বিধিসম্মত নয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ওভারলোডেড গাড়ি
ওভারলোডেড’ পণ্যবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। তা সত্বেও আইনকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে নির্ভয়ে শহরের বুকে দাপিয়ে বেড়ায় এই অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই গাড়িগুলি। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ট্রাফিকপুলিশের সঙ্গে এইসব গাড়িগুলির মাসোহারা বন্দোবস্ত করা থাকে। একেক এলাকার একেক ব্যবস্থা। সেই ভরসাতেই এরা অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই করার সাহস পায়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে কতটা বিপজ্জনক ভাবে গাড়িটি পণ্যবোঝাই করেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শিশুশ্রমিকরা কাজ করে
শিশুশ্রম বেআইনি। কেবল বেআইনিই নয়, কড়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু কলকাতা শহরেই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিশুশ্রমিক চোখে পড়ে। শিশুদের দিয়ে অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়া যায় বলে আইনের ভয় থাকলেও লোভ সামলাতে পারেন না মালিকেরা। অনেকক্ষেত্রে মানবিক কারণেও শিশুশ্রমিক নিয়োগ করা হয়ে থাকে বলে দাবি মালিকদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আইনভঙ্গকারী বাস ও অটো
মজা করে অনেকে বলেন, বিধি লঙ্ঘনের সেরা ঠিকানা শহরের বাস আর অটো। ওভারটেকিং থেকে শুরু করে পথের মাঝে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়া, এদের জুড়ি মেলা ভার। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক কন্ডাকটর ব্যস্ত রাস্তার মাঝপথে দাঁড়িয়ে যাত্রী ডেকে চলেছেন, যা ট্রাফিক আইনে জরিমানাযোগ্য অপরাধ। এখানেও প্রশ্ন এসে যায় সেই ‘মাসোহারার’।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চাকা যদি ফাটে?
সরকার থেকে নিয়ম করে বলা আছে বাসের চাকার স্বাস্থ্য যেন ঠিক থাকে। বিশেষ করে পিছনের চাকার। চাকা ফেটে বাস দূর্ঘটনার নজির কলকাতা শহরে রয়েছে। কিন্তু নিয়মের পরোয়া না করেই দিনের পর দিন খারাপ টায়ার দিয়েই কাজ চালিয়ে দিচ্ছে বাসমালিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
জেব্রাক্রসিং কীসের জন্য?
রাস্তা পারাপারের জন্য শহরে জেব্রাক্রসিং থাকে। জেব্রাক্রসিং-এর ওপর দিয়েই রাস্তা পার করার নিয়ম। ‘শর্টকাট’ জীবনধারায় অভ্যস্ত মানুষ সেইসবের তোয়াক্কা করেন না। চলন্ত গাড়িকে হাত দেখিয়ে পথ পেরোন তারা। এই নাগরিক অজ্ঞানতার কোনও জরিমানা নেই বলেই হয়ত জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করতে পারে কিছু মানুষ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাস্তাতেই গ্যাসের সিলিন্ডার
ব্যস্ত রাস্তা আটকে রাজনৈতিক সভামঞ্চ থেকে শুরু করে পুজো-প্যান্ডেল, কলকাতা শহরে এই বেনিয়ম গুলোই নিয়ম হয়ে গেছে এখন। রাস্তার ওপর রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের অস্থায়ী গোডাউন বানিয়ে রাখার নজিরও এই শহরেই রয়েছে। ওপরের ছবিটি যশোর রোডের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অসচতেন মানুষ
‘সিভিক সেন্স’ শব্দবন্ধটির ব্যাপ্তি অনেকটাই। এর আওতায় কী কী পড়ে তার হয়ত কোনও ব্যকরণ বই নেই। মানুষ নিজের শিক্ষা সচেতনতা- দিয়ে সেই অনুভূতি গড়ে তোলে। নাগরিক অসচেতনতার মাশুল গুনতে হয় একটা শহরকে। যত্রতত্র ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ব্যাগের কারণে বর্ষার সময় আটকে যায় নিকাশি নালা নর্দমা। জমা জলে নরক হয়ে ওঠে তাদেরই প্রিয় শহরের নানান জায়গা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কীভাবে বিধি মানবে কলকাতাবাসী?
সমাজবিদেরা বলছে, আত্মসচেতনতা জরুরি, আবার অনেকে বলছেন, কড়া শাস্তি না দিলে এই রোগ থেকে মুক্তি নেই। শাস্তি দিয়ে একটা প্রজন্মকে আইনের পথে আনতে পারলে তা অভ্যাসে পরিণত হবে এবং তা মজ্জায় প্রবেশ করবে।