মিশরে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাতাহ আল সিসি৷ বুধবার রাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এ ঘোষণা দেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
সিসি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘‘সেনা পোশাকে আপনাদের সামনে এই শেষবারের মত আমার দাঁড়ানো৷ সেনা প্রধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি৷ আমি মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নিজেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করছি৷ মিশরকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে প্রতিদিন আমি আমার লড়াই অব্যাহত রাখব৷''
সিসির এই মনোনয়ন দেশটির লাখো জনগণ স্বাগত জানিয়েছে৷ আরব বসন্তে হোসনি মুবারকের পতনের পর গত তিন বছরে যে অস্থিতিশীলতার মধ্যে দিয়ে দেশটি যাচ্ছে, তার অবসানের জন্য সিসিকে উপযুক্ত মনে করছে জনগণ৷ জুনের আগেই মিশরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা৷ এই নির্বাচনে সিসি খুব সহজেই জয় পাবেন বলে ধারণা বিশ্লেষকদের৷ তাঁরা বলছেন, ‘‘সিসি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন এবং নির্বাচনে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই৷''
মিশরে রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি
হোসনি মুবারক বিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে কম সময়ই শান্তির সুবাতাস বয়েছে মিশরে৷ মুরসিকে হঠানোর আন্দোলন শুরুর পর থেকে বিক্ষোভের আগুন নেভেইনি৷ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি৷ এ নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: imago/Ralph Peters
ধুঁকছে পর্যটন
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পর্যটন শিল্পের৷ দেশের জিডিপিতে ছয় ভাগের এক ভাগ অবদান রাখে পর্যটনশিল্প৷ বৈদেশিক মুদ্রা আসে প্রচুর৷ কিন্তু প্রায় দু’বছর ধরে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকায় পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷ বেশ কিছু ট্র্যাভেল এজেন্সি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিশরে তাদের কাজ বন্ধ রেখেছে৷ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে মিশরে যাওয়ার ব্যাপারে জার্মান নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কৃষিখাতে বিপর্যয়
মিশর থেকে তেল, পোশাক এবং কৃষিপণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এসব খাতে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ৷ কিন্তু রাজনীতির মাঠে অস্থিরতা, সহিংসতা কালো থাবা ফেলেছে খাদ্য এবং কৃষিখাতে৷ রপ্তানি করা দূরের কথা, এ বছর উল্টে কৃষিপণ্য আমদানিও করতে হতে পারে মিশরকে৷
ছবি: Mohammed Hossam/Afp/Getty Images
সুয়েজ নিয়ে মাথাব্যথা
সুয়েজ খালের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহের রুট নিয়ন্ত্রণ করে মিশর৷ সুয়েজ খালে সেনাপ্রহরা রয়েছে৷ তারপরও ক্ষতি রোধ করা যাচ্ছে না৷ তেলের দাম বাড়ছে হু হু করে৷ এ মুহূর্তে দাম গত পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
বন্দরগুলোও সংকটে
কায়রো থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব পোর্ট সাঈদ৷ মিশরের খুব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর৷ দেশের প্রায় সবগুলো বন্দরেই চলছে বিশৃঙ্খলা, উত্তেজনা৷ পণ্য পরিবহন অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শিল্প এবং খনন শিল্প
এই দুটি শিল্পের অবস্থাও খুব খারাপ৷ এই দুটো খাত থেকেও আয় কমছে৷ মিশরের জনসংখ্যা ৮ কোটি ৪০ লাখ, যা কিনা জার্মানির চেয়েও বেশি৷ কিন্তু ২০১২ সালে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল জার্মানির দশ ভাগের এক ভাগের মতো৷ পার্থক্যটা এখন যে আরো বাড়ছে তাতে আর সন্দেহ কী!
ছবি: Khaled Desouki/Afp/Getty Images
রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত
২০১১ সাল থেকেই চলছে রাজনৈতিক সংকট৷ নানা জায়গায় রেল লাইন উপড়ানো হয়েছে বহুবার৷ সংকট শুরুর পর থেকে পাঁচ শতাংশেরও কম পণ্য পরিবহন হয়েছে রেলপথে৷ কায়রো থেকে আলেক্সান্দ্রিয়া এবং সুয়েজ খালের কাছের রেল পথ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের৷ অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: imago/Arnulf Hettrich
বেহাল সড়কপথ
৪৫ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সড়কপথ রয়েছে মিশরে৷ কিন্তু সংকট শুরুর আগে থেকেই দেশের অর্ধেকেরও বেশি সড়কপথের জরা-জীর্ণ অবস্থা৷ জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা দরকার৷ কিন্তু বিক্ষোভ আন্দোলন সে কাজ শুরুই করতে দিচ্ছে না৷ নতুন মোটরপথ তৈরির পরিকল্পনাও ফাইলবন্দি৷
ছবি: Fayez Nureldine/Afp/Getty Images
বিদেশি কোম্পানির পিছটান
কায়রোতে বেশ ভালো ব্যবসা করছিল জার্মানির চেইন শপ ‘মেট্রো’৷ সম্প্রতি মিশরে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে তারা৷ মিশরের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার জার্মানির আরো তিনটি বড় বাণিজ্যিক সংস্থা সরে এসেছে সে দেশ থেকে৷ বিএএসফ, থাইসেনক্রুপ আর হেঙ্কেল নিজেদের কর্মীদের ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে মিশর থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিমান চলাচলে বিলম্ব
বিমানে দেরিতে যাত্রা শুরুর ব্যাপারটি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে মিশরে৷ সময় মতো যাত্রা শুরু করতে চার ঘণ্টা আগে গিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হতে হচ্ছৈ যাত্রীদের৷ এত কঠোর নিরাপত্তা তল্লাসি চলছে যে তার জন্য বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে সবাইকেই৷ জার্মানির লুফৎথানসা এয়ারওয়েজ অবশ্য এখনো কায়রোতে যাওয়া-আসা করছে৷ তবে অনেক দেশের বিমান মিশরে যাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অলাভজনক হয়ে পড়ায় ফ্লাইট বাতিল করতে শুরু করেছে৷
ছবি: imago/Ralph Peters
9 ছবি1 | 9
২০১৩ সালের জুলাইয়ে দেশটিতে প্রবল গণবিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহামেদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদচ্যুত করেন সিসি৷
ব্রাদারহুডের প্রতিক্রিয়া
তবে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির দল মুসলিম ব্রাদারহুড জানিয়েছে সিসি'র নেতৃত্বে দেশে কোন স্থিতিশীলতা আসবে না৷ লন্ডন থেকে টেলিফোনে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য ইব্রাহিম মুনির সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, ‘‘সিসি সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখন প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন৷ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে প্রতিদিন মানুষ হত্যা করছেন তিনি৷'' এদিকে সিসির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুরসি সমর্থক ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহত হয়৷
বিচারের মুখোমুখি ব্রাদারহুড
হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বুধবার নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুডের ৭১৫ সদস্যকে বিচারের মুখোমুখি করার নির্দেশ দিয়েছে মিশরের আদালত৷ এদের মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ বাদিয়েও রয়েছেন৷ একই অপরাধে সোমবার ব্রাদারহুডের ৫২৯ জন কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত৷
২০১৩ সালের ১৪ অগাস্টে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ মিনায় সহিংসতা, হত্যার উসকানি, লোকজনের ওপর হামলা, সরকারি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডকে অভিযুক্ত করে৷ ঐসময় আন্দোলন দমনে ব্রাদারহুড কর্মীদের অবস্থানস্থলে অভিযান চালায় মিশরের নিরাপত্তা বাহিনী৷ ওই অভিযানে ব্রাদারহুডের কয়েকশ' সদস্য নিহত হন৷ আর হাজার হাজার ব্রাদারহুড কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এই সহিংসতার জের ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ব্রাদারহুড সদস্যদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়৷ মঙ্গলবার একই আদালতে আরো ৬৮৩ জন সদস্যের শুনানি হয়৷
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, একসঙ্গে এত মানুষকে প্রাণদণ্ড দেয়া আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী৷ এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জর্ডান সফরের সময় এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, মৃত্যুদণ্ড পথ থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন৷ মোহাম্মদ মুরসিও গত ৩রা জুলাই আটক হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন৷