মিশরে মুবারকের ছায়া ও পশ্চিমা বিশ্বের আচরণ
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বে-আইনি বিক্ষোভে অংশ নেবার দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড৷ এমন রায় শুনে যারা মিশরের বর্তমান সরকারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা ভাবছেন, পথে নেমে প্রতিবাদ করার আগে তাঁরা দু’বার ভাববেন৷ আলা আবদেল-ফাতাহ’র মতো এত খ্যাতিমান নাগরিক অধিকার কর্মীর দশা দেখে সেই উপলব্ধি আরও গভীর হবে৷ মিশরের মানুষ বুঝতে পারছেন, শুধু খ্যাতির জোরে কড়া শাস্তি এড়ানো সম্ভব নয়৷ অন্যদিকে আবার এটাও দেখা যাচ্ছে, খ্যাতির মাত্রা কম হলে শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যেতে পারে৷ কারণ ফাতাহ’র সঙ্গে অন্য যে কম পরিচিত ব্যক্তি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের কয়েকজনের শাস্তির মেয়াদ ১৫ বছর৷
মিশরের মানুষের কাছে এই রায় কোনো বিচ্ছিন্ন প্রবণতা নয়৷ সম্প্রতি মিশরের আদালতে এমন অনেক রায় শোনা গেছে৷ বেশ কয়েকটি মামলায় মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েক’শো সদস্যের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হয়েছে৷ হাজার-হাজার সরকার-বিরোধী নেতাকর্মী জেলে আটক রয়েছে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল স্থানীয় সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, শুধু গত বছরের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ কারাগারে আটক ছিল৷ তাদের মধ্যে বেশিরভাগের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগও আনা হয়নি৷
বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মিলের অভাব নেই৷ ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ সংগঠন সংবাদমাধ্যমের অধিকারের ব়্যাংকিং-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে মিশরকে ১৫৭ স্থানে রেখেছে৷ গত বছর সিনাই উপদ্বীপে এক রক্তাক্ত হামলার পর ১৭টি বেসরকারি ও সরকারি সংবাদপত্রের সম্পাদকরা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন৷ তাঁরা এই অবস্থানকে দেশের কঠিন সময় দেশাত্মবোধের পরিচয় হিসেবে তুলে ধরেন৷ অন্যরা এর মধ্যে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’-এর গন্ধ পেয়েছেন৷
সংবাদমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, সরকার ইন্টারনেটও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷ কিছু ‘ধ্বংসাত্মক আইডিয়া’ বন্ধ করাই নাকি এর উদ্দেশ্য৷ এর মধ্যে রয়েছে ‘বিক্ষোভের ডাক’, ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত’, ‘শ্লেষ, মানহানি ও অশ্লীলতা’ ইত্যাদি৷
সরকার বলছে, দেশের স্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়িত্ববোধই এই রাজনৈতিক নীতির কারণ৷ কিন্তু এই সন্দেহ দানা বাঁধছে, যে ২০১১ সালে বিপ্লবের আগের সময়ে দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাদের আসল উদ্দেশ্য৷ তখন প্রায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই দেশ শাসন করা যেত৷ কেউ প্রতিবাদ জানালেও তা অগ্রাহ্য করা যেত৷ সে সময়কার নীরবতা মোটেই সরকারি নীতির প্রতি জনসমর্থন ছিল না, তার কারণ ছিল সরকারি রোষের ভীতি৷ রাজনৈতিক ‘এলিট শ্রেণি’ তখনো এর পরোয়া করেনি, আজও করে না৷
তবে সেই যুগ আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷ সিনাই উপদ্বীপে সন্ত্রাসবাদ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সবাই সরকারের কড়া নীতির পরোয়া করে না৷ তার উপর প্রশ্ন উঠছে, সরকারের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সংগ্রামের লক্ষ্য কে? সিনাই উপদ্বীপে ‘ইসলামিক স্টেট’-এর সমর্থকরা, নাকি যারা ধর্মীয় অথবা ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আল-সিসি’র রাজনৈতিক নীতির বিরোধিতা করছে, তারা? মিশরের আদালতের সাম্প্রতিকতম রায় দেখিয়ে দিচ্ছে, যে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’-এর সংজ্ঞার আওতায় অনেক কিছুই ধরা যেতে পারে৷
বছর চারেক আগে মুবারক সরকারের পতন হয়েছিল৷ ইউরোপ ও অ্যামেরিকার কাছে এই প্রশাসন ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নোঙর৷ এই মনোভাব মিশর সহ আরব বিশ্বের অনেক স্বৈরাচারী দেশের জনমানসে পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করেছে৷ স্বৈরচারী শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিদ্রোহের মাধ্যমে ফেটে পড়েছে৷ সেই বিদ্রোহে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে৷ মৃত্যুর এই প্রবণতা তখনই থামবে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক সরকার ও সত্যিকারের নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হবে৷ তা না হলে জানতে হবে, এক বিপ্লবের সমাপ্তি মানেই আরেক বিপ্লবের সূচনা৷