1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মিষ্টি স্বাদে, মিষ্টি আধ্যাত্মবাদে

৮ মে ২০১৮

মিষ্টির সঙ্গে আনন্দের একটি যোগ আছে৷ শুধু তাই নয়, যুগ যুগ ধরে উপাদেয় এই খাদ্যটি ভারতবর্ষে রসনা ও মনস্তত্ত্ব দু’জায়গাতেই একেবারে পোক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

ছবি: DW/M. M. Rahman

জার্মানি কেন, ইউরোপ যতটা ঘুরেছি একটাও মিষ্টির দোকান খুঁজে পেলাম না৷ মানে ঐ যে পাড়ার মোড়ে আধবুড়ো কেউ জামার দু'টো বোতাম খুলে কাঁচাপাকা বুকের লোমগুলো নিয়ে বসে আছেন ছোট্ট একটা কাউন্টারের ওপার৷ পাশে একটা হাতপাখা৷

ভেতরে কাঠের টেবিল আর বেঞ্চি৷ তারওপরে আধবুড়ো কাকাটার মতোই আধবুড়ো একটা বা দু'টো ফ্যান অনিচ্ছুক ঘুরছে ওপরে৷ নীচে ঐ বেঞ্চিগুলোতে কয়েকজন বেশ রসিয়ে রসিয়ে ফর্সা রঙের রসগোল্লার পেটে চামচ চালিয়ে দিচ্ছেন সতর্কভাবে৷ গরম ছানাময় মিষ্টির টুকরোটা মুখে পুরে দিয়ে বন্ধ চোখে যেন গলনালী দিয়ে তা পাকস্থলী পর্যন্ত চালান করে দেয়া পর্যন্ত হিসেব বুঝে নিচ্ছেন৷ কেউ কেউ আবার হলদে নোনতা নিমকির মাঝবরাবর কামড়ে দিয়ে স্বাদের এক অপূর্ব ভারসাম্য রক্ষায় ব্যস্ত৷

কম বয়সি দোকানিরা যেমনি ব্যস্ত এই রসিক ক্রেতাদের মনভোজনের আয়োজনে, তেমনি কারো কারো দম ফেলবার সময় নেই, দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের সাদা, লাল, কালো মিষ্টির চারকোণা প্যাকেটের আবদার মেটাতে মেটাতে৷ 

জার্মানিতে কেন নেই, এই দুঃখে চোখে জল আসার কথা৷ কিন্তু আমার জল আসে জিভে, যখনই দেশের মিষ্টিগুলোর কথা মনে পড়ে৷ কল্পনায় রসমালাই, ছানামুখী, রসগোল্লা কিংবা প্যাড়া আর ঝুরা সন্দেশের গন্ধে আমি মাতাল হই৷

অনেক লেখায় পড়েছি, যেই মিষ্টি আমাদের এতটা উতলা করে, সেটি বা সে জাতীয় খাবারের বিস্তারে বিরাট ভূমিকা রেখেছে ভারতবর্ষ৷ এখনো মিষ্টিতে এতটা বৈচিত্র্য আর কোথাও নেই৷

কনফেকশনারির ইতিহাস নিয়ে একবার যুক্তরাজ্যের ডেইলি মিরর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল৷ সেখানে কনফেকশনারি গবেষক টিম রিচার্ডসন মিষ্টির ইতিহাসের একটি টাইমলাইন তুলে ধরেছিলেন৷ তাঁর মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে যখন গুহামানবেরা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখনই মিষ্টিস্বাদের সঙ্গে পরিচিত হয় মানুষ৷ তবে তা এখানে নয়, ভ্যালেন্সিয়াতে৷ সেখানকার গুহাচিত্র গবেষণা করে দেখা যায়, তখনই মানুষ টের পেয়ে যায়, যে মৌচাকের ভেতরে মৌ মৌ করা মধু আসলে এক অমৃত বস্তু৷

কিন্তু মধু তৈরি করতে হয় না৷ তৈরি করা মিষ্টি সম্ভবত পৃথিবীকে প্রথম চিনিয়েছে ভারতবর্ষই৷ ‘সুগার' শব্দটিরই তো উৎপত্তি সংস্কৃত ‘শর্করা' শব্দ থেকে৷ এমনকি ‘ক্যান্ডি' শব্দটিও এসেছে সংস্কৃত ‘খান্ডা' শব্দ থেকে৷ শর্করা হলো, পরিশোধিত চিনি৷ আর খান্ডা হলো অপরিশোধিত চিনি৷

চিনির পরিশোধনও সম্ভবত ভারতবর্ষের লোকেরাই শিখিয়েছে পৃথিবীকে৷ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে তৎকালীন হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর লোকেরা এই মহৎ কাজটি পারতেন বলে কেউ কেউ মনে করেন৷ তখন ব্রোঞ্জ যুগ৷ তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে ৩০০ অব্দ নাগাদ যে এখানে নানান রকমের পরিশোধিত চিনি (শুধু আখ থেকে নয়) প্রস্তুত হতে শুরু করে, তার পরিষ্কার প্রমাণ রয়েছে৷ এ সময়টাতেই ভারতবর্ষের প্রথম মিষ্টি মতিচুরের লাড্ডু তৈরি হয়৷ তবে তা দুধ থেকে নয়৷

‘মিঠাস'-এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে আদি সংস্কৃত সাহিত্যে৷ পরবর্তী সংস্কৃত টেক্সট, যেগুলো বেশ অনেকটাই অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেখানে মিষ্টান্নের ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ১১৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা সোমেশ্বর (তৃতীয়) ‘মানসোল্লাস' সংকলন করেন৷ সেখানে পায়েসাম (পায়েস বা ক্ষীর)-এর উল্লেখ আছে, যাতে সাত রকমের চাল ব্যবহার করা হতো৷ আরো উল্লেখ আছে ‘গোলামু' নামের আরেক মিষ্টি জাতীয় খাবারের, যেটি বর্তমান সময়ের ডোনাটের মতো, ময়দা ও চিনির সিরায় তৈরি হতো৷ পনির ও চালের গুড়া দিয়ে তৈরি করা হতো ‘চানা'৷ এমন আরো অসংখ্য মিষ্টি জাতীয় খাবারের কথা রয়েছে৷ এতেই বোঝা যায়, এ অঞ্চলে মিষ্টির যে বাহার তার সূচনা সুঅতীতেই হয়ে গেছে৷ 

বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষের কাণ্ড!

00:44

This browser does not support the video element.

পরবর্তীতে মিষ্টি নানা রূপ নিয়েছে৷ ভারতবর্ষের একেক অঞ্চলে একেক রকমের ডালপালা মেলেছে৷ বাংলায় নানান মিষ্টান্ন আগেই তৈরি হলেও আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স দুই-আড়াই'শ বছরের বেশি নয়৷

বৈষ্ণবদের নিরামিষ খাবারে বৈচিত্র্য ও স্বাদ আনতেই প্রথম এ অঞ্চলে দুধের তৈরি নানান মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিবেশন করা হতো৷ বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য৷ মহাভারত অনুযায়ী ননি ও মাখন প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের৷ এ জন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত ওই সব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলেই বিবেচিত হতো৷

প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম ব্রাত্য ছিল৷ ড. সুকুমার সেন তাঁর কলিকাতার কাহিনি বইয়ে লিখেছেন, ‘‘ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই –এগুলো কাচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক৷ কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়৷'' ‘ছানা' কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি৷ বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়৷ এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা', এখন বলা হয় ‘ছানা'৷ সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনোরকম উল্লেখ নেই৷ অন্য ভাষাতেও ছিল না৷ আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই৷

নীহাররঞ্জন রায়ের লেখাতেও ছানার কোনো মিষ্টির উল্লেখ নেই৷ তিনি বলেছেন, ‘‘কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়৷'' 

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলেছবি: Zobaer Ahmed

চিনির সঙ্গে ছানাযোগে আধুনিক সন্দেশ ও রসগোল্লার উদ্ভাবন অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে৷ ভূবনজয়ী রসগোল্লার উৎপত্তি কোথায় তা নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাংলাকেই পেটেন্ট দেয়া হয়েছে৷ 

আদি সংস্কৃতি সাহিত্যে মূলত ভোজ ও ভোগ এই দুই উপলক্ষ্যে মিষ্টির ব্যবহারের উল্লেখ আছে৷ তাই ধর্মীয় ও সামাজিক সব উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ মিষ্টি৷ ঈদ-পূজা থেকে শুরু করে সব ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিষ্টি অপরিহার্য৷ নববর্ষসহ নানা পার্বনে মিষ্টি ছাড়া চলবেই না৷ বিয়ে করতে যাবেন? মিষ্টি ছাড়া কনের মুখদর্শনটিও হবে না৷ রাজনৈতিক জয় পরাজয়ের হিসেবটিও জেনে যাবেন কোন পক্ষের সমর্থকদের মুখ থেকে রস গড়িয়ে পড়ছে তা দেখেই৷ পরীক্ষার ফল বেরুলে সবার বাসায় বাসায় মিষ্টি পৌঁছে দেয়া এখনো রেওয়াজ৷

এমনকি বাঙালি মিষ্টি শুধু খাবারের নামই রাখেনি, স্বাদের নামটিও মিষ্টিই রেখে দিয়েছে৷ আর কোনো স্বাদের সঙ্গে কিন্তু এই সংযোগটি নেই৷

আমি একে অ্যালিগরিকালি দেখতে চাই৷ এই মিষ্টিকে বাঙালি এতটাই ভালোবেসেছে যে এতে কোনো ছাড় দিতে তারা রাজি নয়৷ অতিথি আপ্যায়ন বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে শুরু করে যে কোনো শুভ কাজের সঙ্গে মিষ্টিকে জুড়ে দিয়ে বাঙালি এই খাবার বা স্বাদটিকে তাদের মননে একটি পবিত্র ও শুদ্ধ জায়গা দিয়েছে, যা আর কোনো খাবারকে দেয়নি৷ তাই শুধু রসনাতেই আটকে থাকেনি মিষ্টি, অজান্তেই এর মধ্যে আধ্যাত্মবাদও জুড়েছে আষ্টেপৃষ্টে৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ