আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ৷ এ নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কুটনীকিদের ব্রিফ করবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার বিকেলে মন্ত্রনালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘এরইমধ্যে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি৷ বুধবার বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ও মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের আঞ্চলিক কমান্ডার পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়েছে৷ এখন বিদেশি কুটনীতিকদের অবহিত করবো৷ তাঁদের আমরা আমাদের অবস্থান জানাবো৷ তাঁরা যাতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারকে শক্ত চাপ দেয় সেই আহ্বান জানাবো৷'' তবে এ বিষয়ে তিনি আর বিস্তারিত কিছু জানাতে রাজি হননি৷
বাংলাদেশে অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের নিবন্ধন দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘তাঁদের আপাতত উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে না৷ তবে মিয়ানমারের অনিবন্ধিত নাগরিকদের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়েছে এবং সেই জরিপের তথ্য আমাদের কাছে আছে৷''
সুলতানা কামাল
এখন মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেনা জানিয়ে পররাষ্ট্রমমন্ত্রী বলেন, ‘‘তবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রবেশ ঠেকানো এত সহজ নয়৷ আর কিছু ক্ষেত্রে একান্ত মানবিক কারণে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে৷''
এর আগে বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানকে তলব করে ‘চরম উদ্বেগের' কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতের হাতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক পত্র তুলে দেয়া হয়৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিপক্ষীয় সচিব কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা আমাদের চরম উদ্বেগের কথা জানিয়ে মিয়ানমারের লোকজন যাতে ফেরত যেতে পারে সেই ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছি৷ রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করছে বাংলাদেশ৷''
একইদিন আরেকটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব এম. শহীদুল হক বলেছেন, ‘‘একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যতটুকু করা দরকার, বাংলাদেশ ততটুকুই করছে৷ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য সমস্যার উৎস জানতে হবে৷ এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে৷''
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কথা
জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ, এই তিনদিনে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সহিংসতা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার জন৷ অক্টোবরের ২৭ তারিখে তোলা এই ছবিতে ঐ রাজ্যের একটি গ্রামের বাজার দেখা যাচ্ছে, যেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ শিশুরা সেখান থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করছে৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
পালিয়ে বাঁচা
সহিসংতা থেকে বাঁচতে নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা৷ উপরের ছবিটি ২১ নভেম্বরের৷ কক্সবাজারের কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রে বসবাসরত রোহিঙ্গা নারীরা নতুন আসা শরণার্থীদের দেখছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
নতুন শরণার্থী
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন শরণার্থীরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
ধরা পড়ায় কান্না
অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হওয়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা তাদের ধরেছে৷ মুসলিম নারী ও তাঁর সন্তানরা তাই কাঁদছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
অপেক্ষা
কুটুপালাং ক্যাম্পে ঢোকার অপেক্ষায় নতুন আসা রোহিঙ্গারা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সন্তানসহ মা
মুসলিম এই রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানকে নিয়ে কুটুপালাং শিবিরে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
শরণার্থী শিশু
কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের রোহিঙ্গা শিশুরা স্কুলে পড়াশোনার ফাঁকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
আদি বাসিন্দা
কুটুপালাং ক্যাম্পে নিজেদের বাড়িতে শিশুরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
বাড়ির আঙিনায়
একজন রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কুটুপালাং শরণার্থী শিবিরে তাঁর বাড়ির সামনে বসে আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
9 ছবি1 | 9
ইউএনএইচসিআর-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে কক্সবাজার অঞ্চলের তিনটি ক্যাম্পে ৩২ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রয়েছেন৷ তবে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা ওই এলকায় সাড়ে তিন লাখ বলে ধারণা করা হয়৷
অক্টোবর মাস থেকে নতুন করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে এ পর্যন্ত ৮৬ জন নিহত হয়েছে বলে জাসিংঘ জানিয়েছে৷
এদিকে বাংলাদেশে ঢুকতে চাওয়া আরো ১৭৭ জন রোহিঙ্গাকে বৃহস্পতিবার ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি৷ এ পর্যন্ত কয়েক দফায় ৭ শতাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ তবে নানাভাবে দেড় হাজারের মতো রোহিঙ্গা টেকনাফ এলাকায় ডুকে পড়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে৷ আর নৌকায় আসা আরো অনেক রোহিঙ্গা নাফ নদীতে ভাসছে বলে জানাগেছে৷
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, কারণ আমাদের প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার এবং সেখানে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে৷ এই চাপ যেন বড় ধরণের চাপ হয়৷ বাংলাদেশের একার পক্ষে এই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য সবকিছু করা সম্ভব নয়৷ তবে আমরা মুখ ফিরিয়েও থাকতে পারিনা৷ আমাদেরও মানবিক বিষয় দেখতে হবে৷''
রোহিঙ্গাদের ‘যুদ্ধের’ যেন শেষ নেই
ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ অনেক বাংলাদেশিও আছেন তাঁদের মাঝে৷ থাইল্যান্ডে গিয়ে কবরেও ঠাঁই হয়েছে অনেকের! আজকের ছবিঘরটি তাঁদের নিয়েই৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আটকে পড়া
গত ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা৷ একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা৷ সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে৷ ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া মানুষগুলো এখনো মুক্ত নয়৷
ছবি: Reuters/R. Bintang
ক্লান্ত
মানবপাচারকারীরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়াতে সমুদ্রবক্ষে বিপদেই পড়েছিলেন রোহিঙ্গারা৷ আনুমানিক সপ্তাহ খানেক সমুদ্রপথে ঘুরে অবশেষে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত অবস্থায় তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান৷ দীর্ঘ অর্ধাহার, অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে৷ তাঁদের চিকিৎসা চলছে৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা
প্রতিবছর এভাবেই মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শত শত রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশিও থাকেন সব সময়৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলায় অনেক নৌযান ডুবে যায় সাগরে, সলিলসমাধি হয় অনেকের৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি৷
ছবি: Asiapics
ওদের কোনো দেশ নেই!
বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে ৮ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস৷ তবে সংখ্যাটা দ্রুতই কমছে৷ বৌদ্ধদের সঙ্গে দাঙ্গার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না৷ তাদের মতে, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’৷ আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে ঐতিহাসিক কারণেই তাঁদের মিয়ানমার থেকে আগত বহিরাগতের মর্যাদা দেয় বাংলাদেশ৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আধুনিক দাস-বাণিজ্য
মানবপাচারকারীদের কাছে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিরা যেন ক্রীতদাস৷ মাত্র ২০০ ডলারের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নৌযানে তুললেও যাত্রীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়৷ খেতে না দেয়া, ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতন – বলতে গেলে সব ধরণের অত্যাচারই চলে তাঁদের ওপর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Yulinnas
থাইল্যান্ড নিয়ে আতঙ্ক
রোহিঙ্গারা থাইল্যান্ডেও যান৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে আড়াই লাখ মানুষ অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য থাইল্যান্ড অবশ্য একেবারেই নিরাপদ ঠিকানা নয়৷ মানবপাচারকারীরা সে দেশে নিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে৷ মুক্তিপণ না দিলে মেরেও ফেলা হয়৷ সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান পেয়েছে থাই সরকার৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
পরিত্যক্ত
থাইল্যান্ড সরকারের অভিযান শুরুর পর অনেক রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিকে গভীর জঙ্গলে ফেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়৷ মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এ পর্যন্ত অন্তত শ’ খানেক অভিবাসন প্রত্যাশীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে থাই কর্তৃপক্ষ৷