সঠিক তথ্যের ঘাটতির কারণে এটা যাচাই করা কঠিন যে দেশটির সামরিক বাহিনী এগিয়ে রয়েছে, নাকি প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলো৷
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে এগিয়ে রয়েছে কারা? এটি কি সেনাবাহিনী, যেটি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে, নাকি বিভিন্ন সশস্ত্র প্রতিবাদী গোষ্ঠী, যারা গোরিলা কৌশল অবলম্বন করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে?
প্রশ্নটি শুধু দেশটির ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের নয়, বরং প্রতিবেশি দেশগুলো এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা পর্যবেক্ষকরাও একই প্রশ্ন করছেন৷
গত ছয় সপ্তাহে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ এবং সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে যেখানে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে৷
এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কি যুদ্ধে হারতে শুরু করেছে?'' সামরিক বাহিনী এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এন্থনি ডেভিস মনে করেন যে সেনাদের বিরুদ্ধে লড়া প্রতিবাদী শক্তিগুলো জয় পাচ্ছে যদিও সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই তিনি মনে করেছিলেন যে, কোনো ধরনের প্রতিবাদ কোনো ফল বয়ে আনবে না৷
ডেভিস আরো কয়েকটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন৷
অভ্যুত্থান বিরোধীদের গ্রাম পোড়াচ্ছে মিয়ানমার
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে অভ্যুত্থান হয়েছে৷ যারা এর বিরোধিতা করছে তাদের এলাকা পুড়িয়ে দিচ্ছে সামরিক বাহিনী৷
ছবি: REUTERS
একশোর বেশি গ্রামে আগুন
অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ ‘ডাটা ফর মিয়ানমার’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ করে জানিয়েছে, এ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একশোর বেশি গ্রাম পুরোপুরি বা আংশিক পুড়িয়ে দিয়েছে৷ গতবছরের অভ্যুত্থানের বিরোধীদের দমাতে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বেসামরিক ভবন পোড়ানো হয়েছে৷
ছবি: REUTERS
ছবি কথা বলে
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-ইমেজিং কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবস ও নাসার স্যাটেলাইট ইমেজ পরীক্ষা করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে গ্রাম পোড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে৷ এসব গ্রামে প্রধানত বৌদ্ধরা থাকতেন৷
ছবি: PLANET LABS PBC/REUTERS
কেন সাগাইং
কারণ প্রায় এক বছর ধরে ঐ এলাকায় মিয়ানমারের সেনার সঙ্গে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ পিডিএফ-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠীর লড়াই চলছে৷ পিডিএফ হচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর সাবেক সাংসদদের নিয়ে গড়া মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ এনইউজির সশস্ত্র শাখা৷ মিয়ানমারের সামরিক সরকার এনইউজি ও পিডিএফকে অবৈধ ঘোষণা করেছে৷ এবং তাদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছে৷
ছবি: REUTERS
পলায়ন
সামরিক বাহিনীর হামলা ও আগুনের কারণে গ্রামবাসীরা অন্যত্র পালিয়ে গেছেন৷ জাতিসংঘ বলছে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ৫২ হাজারের বেশি মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন৷
ছবি: REUTERS
পুড়ে যাওয়া বিন গ্রাম
৭ ফেব্রুয়ারির এই স্যাটেলাইট ইমেজে সাগাইং এলাকার বিন গ্রামের কিছু অংশ পোড়া দেখা যাচ্ছে৷ সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দা রয়টার্সকে জানান, ৩১ জানুয়ারি তাদের গ্রামে আগুন দেয়া হয়৷ প্রায় একশোর মতো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ তবে কেউ মারা যায়নি বা কাউকে হত্যা করা হয়নি৷
ছবি: PLANET LABS PBC/REUTERS
আগের ছবি
বিন গ্রামটি দেখতে এরকম ছিল৷ গতবছর ২৭ নভেম্বর তোলা ছবি৷
ছবি: PLANET LABS PBC/REUTERS
পুরনো কৌশল
বিরোধীদের দমাতে গ্রামে আগুন দেয়া মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর একটি পুরনো কৌশল বলে কয়েকজন বিশ্লেষক রয়টার্সকে জানিয়েছেন৷ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের গ্রামেও আগুন দিয়েছিল তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Marchand
7 ছবি1 | 7
তবে, আপনি কোন পত্রিকা পড়ছেন তার উপরেও বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে৷ যেমন, দ্য ইকোনোমিস্টে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘‘মিয়ানমারের প্রতিরোধ শক্তি নিজেদের প্রচারণা বিশ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে৷'' এতে লেখা হয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেজিস্টেন্স মুভমেন্টের জয় আসন্ন বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন৷
দ্য ইকোনোমিস্টিরে প্রতিবেদনে বরং বলা হচ্ছে যে জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ক্রমশ ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এবং অস্ত্রের অভাবে তাদের পক্ষে গোরিলা হামলা এবং গুপ্তহত্যার বাইরে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না৷
ফলে একবারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না কারা এগিয়ে রয়েছে, বা কারা পিছিয়ে পড়ছে৷ এমনকি যোদ্ধ এবং অস্ত্র সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলোও বিশ্লেষণভেদে আলাদা আলাদা হচ্ছে৷ যেমন ‘ওয়ার অন দ্য রকস'-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে যে মিয়ানমারের ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)'-এর একলাখের মতো যোদ্ধা রয়েছে, যাদের ৪০ শতাংশের কাছে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত বিভিন্ন অস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর কোনো কোনোটি ঘরে তৈরি৷
কিন্তু ডেভিসের হিসেবে সেনা সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে একলাখের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে বিশ শতাংশেরও কম সশস্ত্র৷
সমস্যা হচ্ছে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ প্রতিবেদনই অনির্ভরযোগ্য তথ্য নির্ভর৷ আর দেশটির গণমাধ্যমও এক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরছে না৷ তাই, এই গৃহযুদ্ধ কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বলা মুশকিল৷
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে হরতাল
এক বছর আগে সেনা বিদ্রোহে ক্ষমতা হারিয়েছিল মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার৷ অভ্যুত্থানের এক বছরে প্রতিবাদে সামিল অসংখ্য মানুষ৷ তারা সামরিক আদেশ অমান্য করেছেন, হরতালে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরোননি কেউ৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ফাঁকা ইয়াঙ্গন
স্ট্র্যান্ড রোড হলো ইয়াঙ্গনের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা৷ মঙ্গলবারে সেটি একেবারে শুনশান ছিল৷ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশ মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছিল এক বছর আগে৷ সামরিক অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ জানিয়ে হরতালের ডাক দেয়া হয়েছিল মিয়ানমারে৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
ব্যবসা চালু রাখার আদেশ অমান্য
মান্দালায় রেলস্টেশনের সামনের প্লাজাটি ছিল একেবারে ফাঁকা৷ অ্যাক্টিভিস্টদের কথায়, এটি ছিল ‘নীরব হরতাল’৷ হরতালে অংশ নিলে ব্যবসা বন্ধের হুমকি দিয়েছিল জুন্টা৷ প্রতিবাদ জানালে কিংবা সেনার বিরুদ্ধে কোনওরকম মিছিল বা সমাবেশ বা প্রচার করলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়েরের হুমকি দেওয়া হয়েছিল৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
পথে নেমে প্রতিবাদ..
গ্রেপ্তারের হুমকিকে পরোয়া করেননি অনেক প্রতিবাদী৷ মান্দালায় বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল গণতন্ত্রপন্থী ব্যানার৷ তাতে লেখা ছিল, ‘জনগণের ইচ্ছার বিরোধিতা করার স্পর্ধা দেখায় কে’৷ তবে সেদিন কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
জুন্টাকে সমর্থন
মিয়ানমারের স্টেট নিউজ সার্ভিস জানিয়েছে, রাজধানী নেপিদোতে মঙ্গলবার সেনাশাসকদের সমর্থনে সমাবেশ হয়েছিল৷ জুন্টা কিছু ক্ষেত্রে সমর্থন পেলেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে যথেষ্ট প্রতিরোধ রয়েছে৷ জাতিসংঘ জানিয়েছে, একাধিক হত্যা, নির্যাতন ও অপহরণ করছে জুন্টা৷ পাশাপাশি, সহিংসতার অভিযোগে জুন্টার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা যৌথভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
বিচার চলছে সু চির
মিয়ানমারে নেত্রী অং সান সু চি সেনা অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত হন৷ সরিয়ে দেওয়া হয় তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে (এনএলডি)৷ গ্রেপ্তার করা হয় সু চিকে৷ একাধিক ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা চালু করা হয়েছে৷ এর ফলে ১৫০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে নেত্রীর! ২০২০ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে৷
ছবি: REUTERS
‘সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স’
গত এক বছরে, বিক্ষোভকারীরা অহিংসভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ একাধিক কর্মসূচি সংগঠিত করেছেন৷ সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী এবং একাধিক পরিষেবার কর্মীদের হরতালে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল৷ এর আগে সর্বশেষ দেশব্যাপী ধর্মঘট হয়েছিল গত ডিসেম্বরে৷ মিয়ানমার জুড়ে শহর ও শহরতলি ছিল একেবারে ফাঁকা৷ মঙ্গলবার ইয়াঙ্গনের বিখ্যাত শোয়েডাগন প্যাগোডার সামনে দেখুন, কোনও মানুষজন নেই৷
ছবি: AFP/Getty Images
সংঘর্ষের এক বছর
সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে, মিয়ানমারে একাধিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে৷ সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিরোধকে সমূলে বিনাশের চেষ্টা করেছে৷ অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে অহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল৷ সেই সময় সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে৷ ২০২১ সালের মার্চ মাসে বিক্ষোভের আঁচ আরও বেড়ে গিয়েছিল৷ তখনকার ছবিতে ধরা পড়েছে, ব্যারিকেডের পিছনে লুকিয়ে রয়েছেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
নথিভুক্ত হওয়া প্রথম মৃত্যু
স্থানীয় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির অনুমান, মিয়ানমারে সামরিক শাসনকালে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে৷ জাতিসংঘ মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যুর রিপোর্ট খতিয়ে দেখছে৷ গত ২১ ফেব্রুয়ারি একজন প্রতিবাদীকে হত্যা করা হয়েছিল৷ তার অন্তিমযাত্রার ছবি দেখা যাচ্ছে এখানে৷ এই মৃত্যুটি প্রথম নথিভুক্ত হয়েছিল৷