রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন অভিযানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আইসিসি৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemra
বিজ্ঞাপন
প্রসিকিউশনের আবেদনে বিচারকরা এই অনুমোদন দিয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার আইসিসির এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে৷ যদিও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে৷
আইসিসির বিবৃতি বলছে, রোহিঙ্গাদের নির্বাসন, ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগত নির্যাতনসহ তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা তদন্তের অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় বিদ্রোহীদের হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের উপর অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী৷ তখন বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা চলে আসেন৷ গত দুই বছরে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন৷
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা তাদের উপর নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেন, যাকে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷
গত বছর সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে মিয়ানমারের বিচার করার এখতিয়ার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত আসার পর প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়েছিল৷
প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্ত শুরুর জন্য আইসিসির কৌঁসুলি ফাতু বেনসুদা একটি আবেদন করেছিলেন৷ এখন বিচারকরা তাতে সায় দেওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগের তদন্তে এটিই হচ্ছে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্যোগ৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং রোহিঙ্গা নেতারা আদালতের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ বাংলাদেশ আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘‘আমি আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাব৷ মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আবারও গণহত্যা হবে৷''
ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত আদালতে বিচার পেতে পারেন বলে মনে করছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস প্রোগ্রামের পরম প্রীত সিং৷