1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মিয়ানমারের সংঘাত ও রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ

শরিফুল হাসান
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি উত্তেজনা বাড়ালেও অনিশ্চয়তা কমায়নি এতটুকুও। বরং নতুন করে আরো অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আছে। শুধু রোহিঙ্গারা নয়, আরাকানের রাখাইনরাও আসতে পারেন।

সপ্তাহের দুদিন যদি প্রত্যাবাসন বন্ধ থাকে, তাহলে সময় লাগবে ১৫ বছর৷ আর যদি দিনে ৩০০-র বদলে ২০০ জন করে ফেরে, তাহলে সময় লাগেব প্রায় ২৪ বছর - লিখেছেন শরিফুল হাসানছবি: Chaideer Mahyuddin/AFP/Getty Images

বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে নির্মিত মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি। কক্সবাজার থেকে উখিয়া হয়ে টেকনাফ পযন্ত এই মেরিন ড্রাইভ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক। উখিয়া আর টেকনাফের খুব কাছেই মিয়ানমার। সে কারণেই বোধহয় গত কয়েকমাস ধরে মিয়ানমারজুড়ে গৃহযুদ্ধ আর সংঘাতের যে উত্তেজনা তার ছোঁয়া পড়েছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই উপজেলাগুলোতে। এই সড়কের পাশের এক দোকানে চা পান করতে নেমে মিয়ানমারের যুদ্ধের আলাপ কানে এলো।

জানুয়ারির শেষ। শীতের বিকেল। চা দোকানে বেশ ভীড়। আড্ডা জমেছে। কয়েকজন বলছিলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে নাকি মাঝে মধ্যে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল এসে পড়ছে। মিয়ানমারের ভবিষ্যতে কী হবে, কারা ক্ষমতা নেবে, সামরিক জান্তার কী হবে- এমন নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ওই চায়ের দোকানে। পরে স্থানীয় এক সাংবাদিকও জানালেন, সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন মিয়ানমারের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন।

অবশ্য কেবল মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের এই চা দোকান কিংবা এখানকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির খবর যারা রাখেন তাদের চোখও এখন মিয়ানমারের দিকে। কারণ, সেখানকার গৃহযুদ্ধময় পরিস্থিতি।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে মিয়ানমার। এরপর কয়েকটি নির্বাচন হলেও ১৯৬২ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সেখানকার সামরিক জান্তা। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে ফের সামরিক অভ্যুত্থাণের পর দেশজুড়ে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। সামরিক জান্তা কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করছে এবং হাজার হাজার তরুণ এতে প্রাণ হারিয়েছেন। গত তিন বছর ধরে দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা চলছে। তবে এই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তরুণরা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং শুরু হয় মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, যা তিন বছর ধরে চলমান।

এর মধ্যেই ২০২১ সালের এপ্রিলে দেশটিতে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠিত হয় যাতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এনইউজি ঘোষণা করে, সামরিক জান্তাকে পরাজিত করে দেশে একটি ‘ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন' গঠন করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস' সংগঠিত হয়। তাঁরা প্রথম দিকে বাড়িতে তৈরি অস্ত্র ও অন্যান্য প্রাথমিক অস্ত্র জোগাড় করেছিলেন। পরে তাঁরা জাতিগত মিলিশিয়াদের সঙ্গে যোগ দেয়।

গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজোট হয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। জোটটি পরিচিতি পেয়েছে ‘থ্রি ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স' নামে। তারা একসঙ্গে মিলে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অপারেশন ১০২৭ নামের একটি অভিযান শুরু করেছে গত ২৭ অক্টোবর থেকে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র এই গোষ্ঠী দ্রুত মিয়ানমারের উত্তর দিককার রাজ্য শানের সামরিক ঘাঁটি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যপথের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী (তাতমাদো) একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়েছে। ২০২১ সালে জান্তারা ক্ষমতা দখল করার পর এই প্রথম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল।

মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো এবং প্রধান শহর ইয়াঙ্গুন শান্ত থাকলেও মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত ছড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীদের কাছে অন্তত ৩৫টি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা বাহিনী। বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় চীন সীমান্তে সংঘর্ষ বন্ধ হলেও দেশের নানা অংশে বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। চলতি গৃহযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বামার-জনতার একাংশও সামরিক জান্তা বা তাতমাদোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। ফলে সামরিক জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং প্রচণ্ড চাপে আছেন। এর মধ্যেই জান্তা সরকার দেশে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়িয়েছে।

থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমারের নাগরিকদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ইরাবতী জানিয়েছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি (ইউডাব্লিউএসপি) শান রাজ্যের হোপাং শহরে চলতি মাসের শুরুর দিকে নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছে। এই রাজ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি জান্তা বাহিনীর কাছ থেকে দুটি শহর দখল করে নিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সামরিক জান্তার সদস্যরা আত্মসর্মপণ করছে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে।

ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের মিনবিয়া শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩৮০ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর দখলে নিয়েছে। রাখাইনের ম্রাউক ইউ, কিউকটা ও রাথেডং এলাকায় দুই পক্ষের লড়াই চলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির লড়াইয়ে অন্তত ১২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর)। গত সপ্তায় প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্রোহী ও জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষের জেরে গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫৫৪ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অসংখ্য মানুষ ঘর ছেড়েছে।

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে বাংলাদেশ। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান ২৮ জানুয়ারি কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মিয়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো বিজিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিজিবি প্রধান কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (৩৪ বিজিবি) অধীন উখিয়ার পালংখালী বিওপি এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বিওপি ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা এবং টেকনাফ ব্যাটালিয়নের (২ বিজিবি) অধীন হোয়াইক্যং বিওপি ও তৎসংলগ্ন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি মিয়ানমার সীমান্তে উদ্ভূত যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন।

ভূরাজনীতির বিষয়াদি ছাড়াও মিয়ানমার ও রাখাইনে কী ঘটে, তাতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসন। ২০২১ সালের ৩ জুন মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) ‘পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট' নামে এ,কটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা' নামে সম্বোধন করেছে। এনইউজি তাদের প্রস্তাবিত ‘ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নে সব জাতিগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করেছে এবং বলেছে, এসব নীতি রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পত্তিতে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের বৈঠকেও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি উঠে এসেছে। ২৮ জানুয়ারির ওই বৈঠকের পর চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা এটাও জানি, প্রত্যাবাসন এখন কিছুটা সমস্যার মুখে পড়েছে। রাখাইনে সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাত বন্ধ করে অস্ত্রবিরতির জন্য আমরা মধ্যস্থতা করছি। রাখাইনে অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠা হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে।''

অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কোনো সময় ভালো ছিল না। কখনো একটু ভালো হয়, আবার কখনো একটু খারাপ হয়। এ পরিস্থিতি সব সময় ছিল। আমরা আশা করি, এ পরিস্থিতি সব সময় থাকবে না। আমরা অতি দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারবো। এটা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে (চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে)। আমরা চীনের সহযোগিতা কামনা করেছি।''

আগেরদিন ২৭ জানুয়ারি নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একটি পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে সেখানেও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি উঠে আসে। ওই বৈঠক শেষে হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরে যাওয়াই একমাত্র সমাধান। তারাও আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে আছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে তাদের প্রচেষ্টা ও চাপ অব্যাহত থাকবে।''

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদের তখন স্থান দিয়েছিলাম। যে রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে এসেছে, তাদের কারণে আমাদের নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। এটি নিয়ে আমরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দলের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের এখানে নিরাপত্তা ও পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হয়েছে। শিবিরগুলো উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশ জনবহুল, রোহিঙ্গাদের জন্য আমরা ভারাক্রান্ত। প্রতিবছর ৩৫ হাজার করে নতুন রোহিঙ্গা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি উত্তরণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।''

মিয়ানমারের চলমান সংকট নিয়ে ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) ‘মিয়ানমারের বর্তমান সংকট এবং প্রতিবেশী অঞ্চলে এর প্রভাব' শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করে। ওই সেমিনারে বক্তারা বলেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের নানা অংশে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের চলমান লড়াই বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে। আর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির অব্যাহত লড়াইয়ে রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট হবে।

এসআইপিজির জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘মিয়ানমারে যা ঘটছে, তাতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। রাখাইনে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়েছে, যা এখন বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে এসে পড়েছে বলে বলা হচ্ছে। এখন রোহিঙ্গারা আবার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে কিনা, এমন আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গারা সীমান্তের কাছে চলে এলে আমাদের সামনে বিকল্প কী? অন্যদিকে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা খুবই নড়বড়ে এক নিরাপত্তা পরিস্থিতির সামনে রয়েছি। ভূরাজনৈতিকভাবে ঝড়ের কেন্দ্রে আছি। ভবিষ্যতে রাখাইনের লড়াই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে।

এই বৈঠকে অনলাইনে যোগ দিয়ে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ও উপদেষ্টা কিয়াও জাও বলেন, রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব এবং অন্যান্য অধিকারসহ প্রকৃত প্রত্যাবাসন চায় মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি)। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য সরকার সামরিক জান্তার পতন ঘটাবে। আমরা একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করবে''

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের জাতীয় সরকারের বক্তব্য অবশ্যই আশাব্যাঞ্জক। কিন্তু মিয়ানমারের মতোই অনিশ্চত রোহঙ্গিাদের ভবিষ্যত।

২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সেনাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার মুখে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ওই বছরেরই নভেম্বরে তড়িঘড়ি করে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। এরপর ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। ‘যাচাই-বাছাই'-এর পর তা থেকে ৬২ হাজার ২৮৫ ব্যক্তির তথ্য নিশ্চিত করে মিয়ানমার। কিন্তু গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসিত হয়নি।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ৷ এর মধ্যে আশ্রয়শিবিরে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যাই ৫ লাখ৷ প্রতিবছর ক্যাম্পে নতুন করে ৩০ হাজার শিশু যুক্ত হচ্ছে৷ বিয়েও হচ্ছে ব্যাপক হারে৷ এভাবে নতুন-পুরোনো মিলে প্রতিদিন রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছেই। ফলে সব রোহিঙ্গাদের ফিরতে কতো সময় লাগবে জানা নেই কারো। তারপরেও কাল থেকেই যদি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে শুরু করে তাহলে ১২ লাখ রোহিঙ্গার ফিরতে কতদিন লাগবে?

চলুন, অঙ্কটা মেলানোর চেষ্টা করি৷ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যেকার চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা৷ সে অনুযায়ী, কাল থেকে যদি অব্যাহতভাবে বছরের ৩৬৫ দিন ৩০০ করে রোহিঙ্গা ফেরে, তাহলে বছরে ফিরবে এক লাখ৷ এই হিসেবে ১২ লাখ লোকের ফিরতে লাগবে অন্তত ১২ বছর৷

সাপ্তাহিক ছুটির কারণে সপ্তাহের দুদিন যদি প্রত্যাবাসন বন্ধ থাকে, তাহলে সময় লাগবে ১৫ বছর৷ আর যদি দিনে ৩০০-র বদলে ২০০ জন করে ফেরে, তাহলে সময় লাগেব প্রায় ২৪ বছর৷ কিন্তু এই সময়ে নতুন করে কত শিশুর জন্ম হবে? সহজ অঙ্কটা বেশ জটিল হয়ে গেল, তাই না? আর সেই জটিলতায় যদি যোগ হয় এমন বাস্তবতা যে, গত ছয় বছরে একজনও ফেরেনি, কবে থেকে ফিরবে কেউ জানে না, এমনকি আদৌ ফিরবে কিনা তা-ও জানা নেই- তাহলে সামনে আসে কেবলি এক অনিশ্চয়তা৷ আর সেই অনিশ্চয়তায় সামনে দাঁড়িয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশও।

বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি উত্তেজনা বাড়ালেও অনিশ্চয়তা কমায়নি এতটুকুও। বরং নতুন করে আরো অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আছে। শুধু রোহিঙ্গারা নয়, আরাকানের রাখাইনরাও আসতে পারেন। ফলে সবমিলিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা আছে। তবে শুধু বাংলাদেশ নয় আরো অনেকের নজরই এখন মিয়ানমারের দিকে।

১ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিং ছিল। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেছেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সরকার বিশেষভাবে নজর রাখছে। পাশাপাশি দেশটি থেকে নতুন করে যাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্ক আছে বাংলাদেশ।

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ