মিয়ানমারের সঙ্গে জার্মানির উন্নয়ন সহযোগিতা স্থগিত
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়েছিলেন জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ড. গার্ড মুলার৷ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে জার্মানির উন্নয়ন সহযোগিতা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার দু' দিনের সফরের প্রথম দিনে ড. গার্ড মুলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ বুধবার সকালে রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজারে যান৷
জার্মানির অর্থনীতি ও উন্নয়ন সহযোগিতা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের খবর অনুযায়ী কুতুপালং শিবির পরিদর্শন শেষে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আজ আমি অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ কুতুপালংয়ের বিশ্বের অন্যতম বড় এই শরণার্থী শিবিরে খড়ের তৈরি ঘরে আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন৷ তাদের অবস্থা দেখে আমি বিমর্ষ৷ জাতিগত নির্মূলের এমন প্রয়াস এবং মানবতাবিরোধী এমন অপরাধ মেনে নেয়া যায় না৷''
জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন মন্ত্রী মনে করেন মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ না বাড়ালে দেশটি কখনোই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না৷ মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে তাই
দেশটির সঙ্গে জার্মানির উন্নয়ন সহযোগিতা স্থগিতের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি, ‘‘১০ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেয়া এবং এখনো সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে না তারা৷ মিয়ানমার যতক্ষণ পর্যন্ত এসব না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে সব উন্নয়ন সহযোগিতা আমরা স্থগিত রাখবো৷''
আদালতে মিয়ানমার - কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর
দ্য হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রশ্নে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানি শুরু হয়েছে৷ মিয়ানমারের বক্তব্য জানাতে উপস্থিত হয়েছেন অং সান সুচিও৷ চলুন এক নজরে জেনে নেই এ বিষয়ক কিছু প্রশ্নের উত্তর৷
ছবি: Getty Images/AFP
কেন গাম্বিয়া?
১৯৭৮ সালে গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসমর্থন করে গাম্বিয়া, ১৯৫৬ সালে কনভেনশন অনুসমর্থন করেছিল মিয়ানমারও৷ কনভেনশনের নয় নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী যেকোনো পক্ষই গণহত্যা প্রতিরোধে বিচার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে৷ অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন- ওআইসির ৫৭ সদস্যের সমর্থনে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া এই মামলা দায়ের করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Ye Aung Thu
গাম্বিয়ার অভিযোগ কী?
গাম্বিয়ার অভিযোগ, বিয়ে ও সন্তান নেয়া, চলাচলসহ রোহিঙ্গাদের নানা মৌলিক অধিকার পরিকল্পিতভাবে হরণ করেছে মিয়ানমার৷ রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে আটে রাখা এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতেও সমর্থনের অভিযোগ আনা হয়েছে৷ গাম্বিয়া বলছে, এর সবকয়টিই ‘জেনোসাইডাল ইনটেন্ট’৷ ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের আগস্টে অভিযান চালিয়ে নারী ও শিশুসহ রোহিঙ্গা হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Htusan
মিয়ানমার কী বলছে?
মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিচার আদালতে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করছে৷ দেশটির সেনাবাহিনী ‘তাতমাদো’ও সরকারের সমর্থনে কাজ করার কথা জানিয়েছে৷ দেশটিতে সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অ্যাকটিভিস্টদের প্রায়ই গ্রেপ্তার নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়৷ তারপরও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিচার আদালতের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/Zuma Press/Km Asad
কেন এ মামলা গুরুত্বপূর্ণ?
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ দীর্ঘদিনের৷ কিন্তু গাম্বিয়া মামলা করার আগ পর্যন্ত মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি৷ এই মামলা শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে৷ এ কারণে মামলা শেষ হওয়ার অন্তর্বর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে গাম্বিয়া বিচার আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছে৷ এ সংক্রান্ত নির্দেশনা খুব দ্রুতই আসতে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Shikder
অন্তর্বর্তী আদেশ কী হতে পারে?
চাইলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া, নাগরিকত্ব দেয়া, বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন, মানবাধিকারকর্মীদের প্রবেশ নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যেকোনো আদেশ দিতে পারে বিচার আদালত৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Htusan
বিচার আদালত কী করতে পারে?
বিচার আদালতের আদেশ মানতে সব পক্ষই বাধ্য৷ পাশাপাশি আদালতের সব আদেশের কপি পাঠানো হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে৷ চাইলে জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থাও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে৷ অভিযোগ প্রমাণিত হলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় প্রশ্নের মুখে পডৃ়তে হতে পারে মিয়ানমারকে৷ পাশাপাশি রায় না মানলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়তে পারে৷
ছবি: DW/ P. Vishwanathan
বিচারক কারা?
বিভিন্ন দেশে বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা ১৫ জনকে নিয়ে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বেঞ্চ৷ তবে মামলার কোনো পক্ষ চাইলে অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন বিচারক নিয়োগের আবেদন করতে পারে৷ সাউথ আফ্রিকার জুরি ড. নাভানেথেম পিললায়কে বিচারক নিয়োগ দিয়েছে গাম্বিয়া৷ তিনি রুয়ান্ডা গণহত্যা ট্রাইব্যুনালের বিচারক ছিলেন৷ মিয়ানমারের নিয়োগ পেয়েছেন জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ক্রেস৷
ছবি: Getty Images/AFP
গণহত্যার আর কোন রায়?
২০০৭ সালে বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনার স্রেব্রেনিকায় সার্বিয়া গণহত্যা চালিয়েছে বলে রায় দেয়৷ একই সঙ্গে বসনিয়ার সার্ব জেনারেল রাতকো ম্লাদিচকে গ্রেপ্তার ও হস্তান্তর না করে সার্বিয়া গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে বলেও রায়ে বলা হয়৷ শেষ পর্যন্ত ম্লাদিচকে ২০১১ সালে ইয়ুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় সার্বিয়া৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/B. Armangue
আর কী কী ব্য়বস্থা?
নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর অনুমতি দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসি৷ বাংলাদেশ ২০১০ সালে আইসিসির সদস্য হলেও মিয়ানমার সদস্য নয়৷ নভেম্বরেই আর্জেন্টিনার আদালতে রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি তদন্ত দল গঠন করে৷ তবে এই দলকে সহযোগিতা না করার ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Htusan
মিয়ানমার কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্য়র্থ হয়েছে মিয়ানমার৷ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে৷ কিন্তু এরপর রোহিঙ্গা গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়াসহ গণহত্যার সব প্রমাণ মুছে ফেলার অভিযোগ আসে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে৷ ইন দিন গ্রামে গণহত্যায় জড়িত থাকা সাত সেনাসদস্যকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হলেও মাত্র সাত মাস পর তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Aung Thu
10 ছবি1 | 10
মঙ্গলবার ড. গার্ড ম্যুলারের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রোহিঙ্গা-সংকট নিরসনে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর কথা বলেছিলেন৷ সেদিন বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করতে জার্মানিসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য এক বিরাট বোঝা এবং তারা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে৷ মিয়ানমারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ থেকে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যেতে হবে৷''
রোহিঙ্গাদের জন্য ১৫ মিলিয়ন ইউরো
কুতুপালং শিবির পরিদর্শন শেষে জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ১৫ মিলিয়ন, অর্থাৎ এক কোটি ৫০ লাখ ইউরো অর্থসহায়তার ঘোষণাও দেন ড. গার্ড ম্যুলার৷ তিনি জানান, রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া এবং পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা (স্যানিটেশন)-র উন্নয়নে এ অর্থ খরচ করা হবে৷
এ সফরে তৈরি পোশাকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গার্মেন্টস মালিকদের সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন জার্মান মন্ত্রী৷