মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘গণহত্যার অভিপ্রায়ে’ রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে মনে করে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন৷ মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ পাঁচ জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিচারের দাবিও তোলা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান ছাড়াও দেশটির সেনাবহিনীর আরো পাঁচ জ্যেষ্ঠ কমান্ডারকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করে জাতিসঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন৷
বার্তা সংস্থা ডিপিএ’র এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে গণহত্যার মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে৷ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, শিশুদের ওপর নির্যাতনসহ নানা ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এছাড়া মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিং অং লাইং ছাড়াও সেনাবাহিনীর আরো পাঁচজন জেষ্ঠ্য কমান্ডারকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে৷
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান৷ শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল৷ তাঁদের কথায় পাওয়া যায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ৷
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে৷ তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়৷
প্রতিবেদনটি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আনএদালনের নেত্রী নোবেল জয়ী অং সান সুচি’রও সমালোচনা করেছে৷ রোহিঙ্গাদের উপর চলা এ নৃশংসতা বন্ধে সুচি কোনো ‘কর্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন’ বলে প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷