সহিংসতার কারণ দেখিয়ে মিয়ানমারে জার্মান সহায়তায় পরিচালিত কয়েকটি প্রকল্পের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে জার্মান সরকার৷ সংঘাত বন্ধ হলে সেগুলো আবার চালু হবে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ক্যাথরিনা ম্যানৎস সোমবার বলেন, যেসব অঞ্চলে সহিংসতা চলছে সেখানে প্রকল্পগুলো ‘নিস্ক্রিয় অবস্থায়' রাখা হয়েছে৷ যখনই সংঘাত বন্ধ হবে তখনই সেগুলো আবার চালু করা হবে বলেও জানান তিনি৷ ম্যানৎস জানান, খাদ্য নিরাপত্তা, চাকরি সৃষ্টি ও চিকিৎসা সেবা খাতে সহায়তা দিয়ে থাকে জার্মানি৷
এদিকে জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফান সাইবার্ট বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধের দেশ মিয়ানমারের ‘নাটকীয় অবস্থা' খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে জার্মানি৷ সংঘাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ও ‘বিশেষ করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চিকে' সংঘাত বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি৷
এর আগে শনিবার এক বিবৃতিতে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গাব্রিয়েল বলেছিলেন, ‘‘মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস পরিস্থিতিতে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন৷ এতে করে আবারও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে৷ সাধারণ মানুষদের জীবনের স্বার্থে আমি সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই৷'' এতসংখ্যক রোহিঙ্গাকে সামলানো বাংলাদেশের জন্য কঠিন বলেও মন্তব্য করেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ ‘‘বাংলাদেশের এমন পদক্ষেপকে আমরা প্রশংসা করি ও স্বাগত জানাই,'' বলেন তিনি৷
এদিকে মিয়ানমারের সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করতে বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে৷ ব্রিটেন ও সুইডেনের অনুরোধে এই বৈঠক বসছে৷
জাতিসংঘের কূটনীতিকরা বলছেন, মিয়ানমারের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন মিয়ানমারের সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা প্রতিহত করছে৷
এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান জায়িদ রা'দ আল হুসেইন সোমবার বলেন, মিয়ানমারে যে সহিংসতা চলছে তা ‘এথনিক ক্লিনজিংয়ের একটি টেক্সটবুক উদাহরণ' বলে মনে হচ্ছে৷ তিনি বলেন, দেশটিতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা সহিংসতা আর অবিচারের মুখোমুখি হচ্ছে৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারীদের সেখানে যেতে দেয়া হয়নি৷ জায়িদ, যিনি জর্ডানের একজন প্রিন্স, বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ঘর-বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে - মিয়ানমার সরকারকে তাদের এমন দাবি থেকে সরে আসতে হবে৷'' তিনি এই পরিস্থিতিকে ‘বাস্তবতাকে অস্বীকার' বলে মন্তব্য করেন৷
এদিকে সোমবার দিনের শেষে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷ অং সান সু চি এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান৷ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ যেসব বিবৃতি প্রকাশ করেছে, মিয়ানমার তাকে স্বাগত জানায়৷'' তবে বিবৃতিতে জাতিসংঘের এথনিক ক্লিনজিং বিষয়ক অভিযোগের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে তাদের যে দায়িত্ব, তা পালন করছে বলেও ঐ বিবৃতিতে জানানো হয়৷
জেডএইচ/এসিবি (এপি, এএফপি)
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷