মুহিব উল্লাহকে দেখলে কোনো মানবাধিকার তদন্তকারী মনে হবে না৷ তিনি পান খান এবং প্লাস্টিক আর বাঁশ দিয়ে তৈরি এক ঝুপড়ি ঘরে থাকেন৷ মাঝেমাঝে তাঁকে রোহিঙ্গা শিবিরে লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন সংগ্রহ করতেও দেখা যায়৷
বিজ্ঞাপন
তবে আপাত সাধারণ এই মানুষটা আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সঙ্গে নিয়ে এমন এক কাজ করেছেন যা উন্নয়নসংস্থা, বিভিন্ন দেশের সরকার, এমনকি সাংবাদিকদের পক্ষেও করা সম্ভব হয়নি৷ তাঁরা গত বছর মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে সেদেশের সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন চলাকালে যারা নিহত হয়েছেন বলে শোনা গেছে, তাঁদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সেদেশের নাগরিক মনে করে না৷ দেশটি রোহিঙ্গাদের এমন ‘বাঙালি' বা ‘মুসলমান' হিসেবে বিবেচনা করে, যারা অন্যদেশ থেকে সেদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন৷
বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করা সাহায্য সংস্থা ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স'-এর হিসেব অনুযায়ী, গত বছরের সহিংসতার প্রথম মাসেই অন্তত ৬,৭০০ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন৷ টেকনাফে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে জরিপ চালিয়ে তৈরি সেই হিসেবে শুধুমাত্র একমাসে নিহতদের সংখ্যা বলা হলেও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি৷
রোহিঙ্গাদের ‘যুদ্ধের’ যেন শেষ নেই
ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ অনেক বাংলাদেশিও আছেন তাঁদের মাঝে৷ থাইল্যান্ডে গিয়ে কবরেও ঠাঁই হয়েছে অনেকের! আজকের ছবিঘরটি তাঁদের নিয়েই৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আটকে পড়া
গত ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা৷ একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা৷ সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে৷ ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া মানুষগুলো এখনো মুক্ত নয়৷
ছবি: Reuters/R. Bintang
ক্লান্ত
মানবপাচারকারীরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়াতে সমুদ্রবক্ষে বিপদেই পড়েছিলেন রোহিঙ্গারা৷ আনুমানিক সপ্তাহ খানেক সমুদ্রপথে ঘুরে অবশেষে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত অবস্থায় তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান৷ দীর্ঘ অর্ধাহার, অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে৷ তাঁদের চিকিৎসা চলছে৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা
প্রতিবছর এভাবেই মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শত শত রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশিও থাকেন সব সময়৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলায় অনেক নৌযান ডুবে যায় সাগরে, সলিলসমাধি হয় অনেকের৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি৷
ছবি: Asiapics
ওদের কোনো দেশ নেই!
বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে ৮ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস৷ তবে সংখ্যাটা দ্রুতই কমছে৷ বৌদ্ধদের সঙ্গে দাঙ্গার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না৷ তাদের মতে, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’৷ আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে ঐতিহাসিক কারণেই তাঁদের মিয়ানমার থেকে আগত বহিরাগতের মর্যাদা দেয় বাংলাদেশ৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আধুনিক দাস-বাণিজ্য
মানবপাচারকারীদের কাছে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিরা যেন ক্রীতদাস৷ মাত্র ২০০ ডলারের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নৌযানে তুললেও যাত্রীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়৷ খেতে না দেয়া, ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতন – বলতে গেলে সব ধরণের অত্যাচারই চলে তাঁদের ওপর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Yulinnas
থাইল্যান্ড নিয়ে আতঙ্ক
রোহিঙ্গারা থাইল্যান্ডেও যান৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে আড়াই লাখ মানুষ অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য থাইল্যান্ড অবশ্য একেবারেই নিরাপদ ঠিকানা নয়৷ মানবপাচারকারীরা সে দেশে নিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে৷ মুক্তিপণ না দিলে মেরেও ফেলা হয়৷ সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান পেয়েছে থাই সরকার৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
পরিত্যক্ত
থাইল্যান্ড সরকারের অভিযান শুরুর পর অনেক রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিকে গভীর জঙ্গলে ফেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়৷ মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এ পর্যন্ত অন্তত শ’ খানেক অভিবাসন প্রত্যাশীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে থাই কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: AFP/Getty Images/Str
7 ছবি1 | 7
রোহিঙ্গাদের নিজেদের তৈরি নিহতদের সাম্প্রতিক তালিকাটি অবশ্য বেশ বিস্তৃত৷ তাঁদের হিসেবে, সহিংসতায় প্রাণ হারানো রোহিঙ্গার সংখ্যা দশ হাজারের বেশি৷ এতে অবশ্য শুধু গত আগস্টই নয়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে আরেক সহিংসতায় নিহতদের কথাও যোগ করা হয়েছে৷ তালিকাতে নিহতের নাম, বয়স, বাবার নাম, মিয়ানমারের ঠিকানা এবং কিভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ রয়েছে৷
নতুন এই তালিকার বিষয়ে মুহিব উল্লাহ বলেন, ‘‘আমি যখন নিজেই শরণার্থীতে পরিণত হয়ে যাই, তখন এ ব্যাপারে কিছু একটা করার তাগাদা অনুভব করি৷'' তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে এই তালিকা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতার এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কাজ করবে৷
রোহিঙ্গাদের তৈরি তালিকার বিষয়ে কথা বলতে মিয়ানমার সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে বার্তাসংস্থা রয়টার্স৷ কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি৷ গত বছরের শেষের দিকে অবশ্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছিল যে, আগস্ট মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর ১৩ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল৷ এছাড়া ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিদের' বিরুদ্ধে ২৫ আগস্ট থেকে ৫ অক্টোবর অবধি সেনাঅভিযান চলাকালে ৩৭৬ জন রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধারের কথাও স্বীকার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী৷