সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রক্তাক্ত দিন পার করল মিয়ানমার৷ গুলি, স্মোক গ্রেনেড ছুঁড়ে বিক্ষোভকারীদের দমন করেছে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী৷
বিজ্ঞাপন
অন্তত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ৷ চার সপ্তাহ আগে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ছিল এদিন৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, দেশটির বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ‘প্রাণঘাতী শক্তি' ব্যবহার করেছে৷ বিশ্বস্ত সূত্রে সংস্থাটি অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানি ও ৩০ জন আহত হওয়ার খবর জানতে পেরেছে৷
দক্ষিণের শহর দাওয়াইতে গুলি চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ খিয়াও মিন টিকে৷ এই মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় গণমাধ্যমও৷
গুলি চালানো হয়েছে ইয়াঙ্গুনেও৷ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ একজনকে আনার পর মৃত্যু হয়েছে বলে সেখানকার একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন৷ মিয়ানমারের মিডিয়া আউটলেট মিজিমাও এই তথ্য দিয়েছে৷
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘মিয়ানমারের বেড়ে চলা সহিংসতার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি৷ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর শক্তি প্রয়োগ অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানাই৷’’
ইয়াঙ্গুনে অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে৷ ডয়চে ভেলের কাছে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আন্দোলনকারী দাবি করেন, অ্যাম্বুলেন্স ও হাসপাতালেও হামলা চালিয়েছে সামরিক বাহিনী৷
এদিকে মিয়ানমারে জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত কিয়াউ মো তুন শুক্রবার সামরিক বাহিনীর সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখেন৷ অং সান সু চির বেসামরিক সরকারের পক্ষে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি৷
এই ঘটনার জেরে শনিবার তাকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে৷ কারণ হিসেবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বলেছে, তিনি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও দূত হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন৷
এদিকে কিয়াও মো তুন রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘যত দিন সম্ভব আমি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’’
মিয়ানমারের শান রাজ্যের ইন্থা জাতিগত গোষ্ঠী সম্প্রতি দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমী এক প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করে৷ সেখানকার ইনলে লেকে নৌকায় চড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা৷
ছবি: Robert Bociaga
বিস্তৃত প্রতিবাদ
মিয়ানমারে ০১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে৷ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশটির জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ইনলে লেকের কাছের বাসিন্দারা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবিতে এক অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন৷
ছবি: Robert Bociaga
নৌকায় করে প্রতিবাদ
সব শ্রেণির মানুষ নৌকায় করে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন৷ তাদের হাতে ছিল মেগাফোন এবং প্ল্যাকার্ড৷ প্রতিবাদকারীরা সমস্বরে বিপ্লবী গানও গেয়েছেন৷
ছবি: Robert Bociaga/DW
সামরিক অভ্যুত্থান
মিয়ানমারের ঊধ্বর্তন সামরিক কর্মকর্তারা চলতি মাসের শুরুতে শাসন ক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নেন৷ তাদের দাবি, দেশটিতে গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল৷ সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছিল অং সান সু চি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
আইন অমান্য
সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে হাজার হাজার মানুষ মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন৷ সামরিক জান্তার জারি করা বিভিন্ন আইন দল বেঁধে অমান্য করছেন তারা৷ তবে, আন্দোলনকারীদের দমনে সামরিক জান্তাও কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার মধ্যে প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার, দমনপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে৷ ইতোমধ্যে কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণও হারিয়েছেন৷
ছবি: REUTERS
নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়েছে লেকের প্রতিবাদকারীরা
পশ্চিমা দেশগুলো অভ্যুত্থানকারী নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং সু চিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করেছে৷ ইনলা লেকের প্রতিবাদকারীরা এই নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করতে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যা একটি ভালো ব্যাপার৷ তবে তারা আবারও ঊধ্বর্তন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে রাজি নন, যা সু চির নীতি ছিল৷
ছবি: Robert Bociaga
গণতন্ত্রই সমাধান
ইন্থা জনগোষ্ঠী মনে করে দেশটির সংখ্যালঘুদের ঐতিহ্য রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে গণতান্ত্রিক এবং বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা৷ এ কারণে মিয়ানমারে কেন্দ্রীয় গণতন্ত্র প্রয়োজন বলে মনে করেন এক প্রতিবাদকারী৷
ছবি: Robert Bociaga
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার
যদিও সু চি’র এনএলডি পার্টি গণতান্ত্রিক যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেসব পূরণ করেনি, তারপরও ইনলে লেকের বাসিন্দারা দলটির প্রতি অনুগত থাকতে আগ্রহী৷ তবে বৃহস্পতিবারের প্রতিবাদকারীরা তাদের কর্মসূচিকে এনএলডি’র পক্ষের কোনো সমাবেশ নয়, বরং গণতন্ত্র পুনরাদ্ধের জন্য প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচনা করছেন৷
ছবি: Robert Bociaga
সেনানিয়ন্ত্রিত পর্যটন
ইনলে লেক পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা হলেও স্থানীয় ইন্থা সম্প্রদায় তা থেকে খুব একটা লাভবান হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন৷ সেখানকার অধিকাংশ হোটেল এবং অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা৷ সামরিক অভ্যুত্থানের আগে স্থানীয়রা পর্যটন খাত থেকে যতটুকু লাভবান হতে পারতেন, এখন তা-ও পারছেন না৷