রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের কমিউনিটির সাথে একীভূত করার প্রস্তাব রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না করে উল্টো মিয়ানমারকে শক্তিশালী করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিজ্ঞাপন
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক মিয়ানমারে এখন ব্যবসা দেখছে, তারা মানবতা দেখছে না, গণহত্যা দেখছে না। তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে স্বস্তিতে রেখে ব্যবসার পথ খুলতে চাইছে, কিন্তু তা বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না।
মিয়ানমারে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে যে বোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টার মধ্যেই বিশ্বব্যাংক নতুন এক প্রস্তাব দিয়েছে। সেই প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, কাজ, চলাফেরা, জমি কেনা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হওয়াসহ সব ধরনের আইনি অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘‘এই প্রস্তাব আমরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছি।’’
বাংলাদেশ মনে করে, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত নেয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
শহিদুল হক
শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের কুতুপালং এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত আসা আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন সেখানে।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, ভাসানচর ও কক্সবাজারেরগুলোসহ ৩৫টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বয়সই ১৮ বছরের নীচে। আর এই ১১ লাখের মধ্যে সাত লাখ মিয়ানমার থেকে আসেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতনের মুখে।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার চুক্তি করে ২০১৮ সালে৷ বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট ছয় লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠালেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নেয়নি। আর সামারিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর সেই চুক্তি নিয়ে নতুন করে আর কোনো কথাও হয়নি।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহিদুল হক বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাবকে ‘ফানি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ''ওখানে কিছু কথিত বিশেষজ্ঞ আছে, যারা মাঝেমধ্যে এরকম উদ্ভট কিছু প্রস্তাব দেয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিকভাবেই এর জবাব দিয়েছেন।’’
তিনি মনে করেন, ‘‘বিশ্বব্যাংক যা বলছে তা মানলে পুরো বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়বে। তুরস্কে গিয়ে দেখেন হাজার হাজার শরণার্থী রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন ভারতে শরণার্থী হয়ে গিয়েছি, আমরা কি স্বাধীনভাবে ক্যাম্পের বাইরে যেতে পেরেছি?’’
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
তার মতে, বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাবকে তেমন গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই, তারা হয়ত রোহিঙ্গা শরণর্থীদের শিক্ষাসহ কিছু সুযোগ -সুবিধার কথা বলছে। তারা পুরোপুরি ইন্টিগ্রেশনের কথা বলছে না। সেটা সম্ভবও নয়।
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বিশ্বব্যাংক মিয়ানমারে ব্যাবসা দেখেছে। তাই তারা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর চেয়ে বাংলাদেশেই সুবিধা দিতে চায়, যাতে মিয়ানমারের সামরিক সরকার স্বস্তি পায়।
তিনি বলেন, ‘‘চীনসহ অনেক দেশই এখন মিয়ানমারে ব্যবসা দেখছে। বিশ্বব্যাংকও এখন সেই ব্যবসার অংশীদার হতে চায়। নানা দেশের সাথে তাদের যে চুক্তি হয়, এর মাধ্যমে সেই চুক্তিতে তারা সুবিধা নিতে চায়।’’
তিনি আরো বলেন,‘‘পশ্চিমা দেশগুলো এরইমধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অনাগ্রহী হতে শুরু করেছে। প্রচারণা শুরু হয়েছে রোহিঙ্গারা এখানেই (বাংলাদেশে) ভালো থাকবে। আর এই বিশ্বব্যাংক তাদেরই ব্যাংক আসলে। তাই তাদের ব্যবসা বাণিজ্যই দেখছে।’’
তিনি মনে করেন, ‘‘আগের সেই দিন নেই। পদ্মাসেতু নিয়েই তারা কিছু করতে পারেনি, আর এখন কী করবে? তাদের কোনো চাপ বা প্রস্তাবে সায় দেবে না বাংলাদেশ৷’’
তার মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সঠিক কাজ করেছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরের ছবিঘর দেখুন...
ভাসানচরে স্থানান্তর: কী বলছেন রোহিঙ্গারা
শুক্রবার রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচ ভাসানচরে পৌঁছেছে৷ তাদের অনেকে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা দেখে ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন৷ তবে জোর বা নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ভাসানচর প্রকল্প
প্রায় তিন হাজার একশ কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ভাসানচরে যাওয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার আলাদা ঘর পাচ্ছে, আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা৷ সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ৷
ছবি: DW/A. Islam
প্রথম ব্যাচ পৌঁছেছে
বাসে ও জাহাজে করে প্রথম ধাপে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা শুক্রবার ভাসানচরে পৌঁছেছেন৷ পরে তাদের অনেককে মোবাইল ফোনে কক্সবাজারে থাকা সঙ্গীদের ভাসানচরের খবর দিতে দেখা গেছে৷ কেউ কেউ ভিডিও কলও করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
বাবা-মাকে আনতে চান হোসেন
কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্প থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসনচরে গেছেন মোহাম্মদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে অনেক ভালো লাগছে৷ আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাবো৷ ওখানে গিয়ে তাদের (বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার) নিয়ে আসবো৷ তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসবো৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
‘আল্লাহ মিলায়ে দিছে’
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে গেছেন মোহাম্মদ জোবায়ের৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না৷ জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি৷ আল্লাহ আমাদের মিলায়ে দিছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
নিরাপত্তাবোধ
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া আবদুর রহমান এখন নিজেকে কিছুটা নিরাপদ ভাবছেন৷ ‘‘ওখানে (বালুখালী ক্যাম্পে) ঘরের বেড়া কেটে চুরি করে নিয়ে যেতো৷ ঘুমিয়ে থাকলে ছুরিও মারতো৷ এখানে তা পারবে না৷ যে ঘরটা পেলাম, সেটা খুবই নিরাপদ৷ কেউ চাইলেই চুরি করতে বা ঘরে ঢুকতে পারবে না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে’
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ভাসানচরে যাওয়া আব্দুস সামাদ বলেন, ‘‘এখানে এসে খুব ভালো লাগছে৷ ঘরবাড়ি অনেক৷ অনেক বড় বড় রুম৷ এখানে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে৷ বড় খেলার মাঠ আছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে জায়গা কম৷ মানুষ অনেক৷ একজন বের হলে আরেকজন বের হওয়ার জায়গা থাকে না৷’’
ছবি: DW/N. Conrad
পার্থক্য
ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য সম্পর্কে জমিনা আক্তার বলেন, ‘‘এখানে বেশি ভালো লাগছে৷ ভালো ঘর, থাকার জায়গা ভালো৷’’
ছবি: bdnews24.com
নির্যাতনের অভিযোগ
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত ৬০ বছর বয়সি শরণার্থী সুফিয়া খাতুন এএফপিকে জানান, ‘‘আমার ছেলে যেন ঐ দ্বীপে যেতে রাজি হয় সেজন্য তারা আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে, তার দাঁত ভেঙে ফেলেছে৷ আমি এখানে তাকে ও তার পরিবারকে হয়ত শেষবারের মতো দেখতে এসেছি৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
‘নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না’
ট্রানজিট ক্যাম্পে উপস্থিত আরেক শরণার্থী হাফেজ আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘‘গত দুইদিন ধরে আমার ভাই নিখোঁজ ছিল৷ আমরা জানতে পেরেছি, সে এখানে আছে৷ এখান থেকে তাকে দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সে সেখানে নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জাতিসংঘের আশঙ্কা, অভিযোগ
জাতিসংঘের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ভাসানচরে পানি উঠে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠতে পারে৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তাদের৷ ভাসানচরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে রোহিঙ্গারা যেন ‘স্বাধীন ও তথ্যসমৃদ্ধ’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
ছবি: DW/A. Islam
‘ভুল ব্যাখ্যা’ না দেয়ার অনুরোধ
রোহিঙ্গারা ‘স্বেচ্ছায়’ ভাসানচরে গেছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ‘‘জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একমাত্র বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হওয়া উচিত প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সেটাই একমাত্র স্থায়ী সমাধান৷ একইসঙ্গে বাংলাদেশের আন্তরিক চেষ্টাকে খাটো করা ও ভুল ব্যাখ্যা না করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিএনপির বক্তব্য
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ায় তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি৷ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘আত্মহনন’ বলেও আখ্যায়িত করেছে দলটি৷