চরমপন্থি বিদ্রোহীদের হামলা এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অন্তত ৮৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ দেশটির সেনাবাহিনী বলছে, অস্ত্রধারী বিদ্রোহীরা ২৪টি পুলিশ চেকপোস্ট ও একটি সেনাঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার গভীর রাতে শুরু হওয়া সংঘর্ষ এখনও বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে চলার খবর জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম৷ মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের এই রাজ্যে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা সহিংসতায় নতুন মাত্রা যোগ করলো এই হামলা৷ অক্টোবরে একই ধরনের হামলার পর সেনাবাহিনী বড় ধরনের অভিযান চালায়৷ এই অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে৷
অক্টোবর হামলায় জড়িত আরাকান রোহিঙ্গা সেলভেশন আর্মি (এআরএসএ) শুক্রবারের হামলারও দায় স্বীকার করেছে৷ এ ধরনের আরো হামলা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে সশস্ত্র এ সংগঠনটি৷
নিহত ৩২ জনের মধ্যে ২১ জন বিদ্রোহী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১১ জন সদস্য রয়েছেন বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী৷
‘‘রাত একটার দিকে বাঙালি সন্ত্রাসীরা উত্তর রাখাইনের মংডুতে একটি পুলিশ স্টেশনে হাতে তৈরি বোমা নিয়ে হামলা চালায়৷ এরপর একই সাথে হামলা চালানো হয় আরো কয়েকটি পুলিশ চেকপোস্টে'', এক বিবৃতিতে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় নেতা অং সান সুচির প্রেস দল৷
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷ দেশটির সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে রোহিঙ্গা কোনো স্বতন্ত্র জাতিসত্তা নয়, বরং বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যাওয়া বাঙালি৷ দেশটির নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমেও অধিকাংশক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি' বলে সম্বোধন করা হয়৷ তবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলেই মনে করে৷
কয়েক দশকের সেনাশাসন থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও এখনও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে ১১ লাখেরও বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা নিপীড়ন থামেনি৷ বছরের পর বছর ধরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, ধরপাকড় ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন রোহিঙ্গারা৷ সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বৈধ-অবৈধভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা৷ ভারতেও বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের বসবাস৷
বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও, তাতে কার্যকর কোনো ফল আসেনি৷
রাখাইন রাজ্যে অস্থিরতা ও সহিংসতা থেকে বাঁচতে শুক্রবার রাত থেকেই দলে দলে রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকিয়ে নিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷ তবে প্রতিবারের মতোই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি সদস্যরা সীমান্ত থেকে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছেন রোহিঙ্গাদের৷
কয়েকটি নৌকায় আসা মোট ১৪৬ জন রোহিঙ্গাকে খাবার, পানি ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর ফেরত পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন বিজিবি কর্মকর্তারা৷ তবে রাখাইনে সহিংসতা চলতে থাকলে আরো রোহিঙ্গা সীমানা পাড়ি দিতে পারেন বলে আশংকা করছে বাংলাদেশ৷
এদিকে, আগস্টের শুরু দিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছে ‘অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত' করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে৷ এদের মধ্যে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছে৷ চিঠিতে শরণার্থীদের ‘সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি' এবং দেশটির সম্পদের ওপর 'বোঝা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ তবে দেশে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জোর করে আবার ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা জানিয়েছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন৷
ওদিকে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি তদন্তে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি মিয়ানমার সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে৷ এতে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘স্টেটলেস পিপল' বা ‘দেশহীন জনগোষ্ঠী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷
রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারকে আহ্বানও জানিয়েছে কোফি আনান কমিশন৷ তবে এ নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি মিয়ানমার সরকার৷
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানকে প্রধান করে এই পরামর্শক কমিটি গঠন করেন৷
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷