‘মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশের কোনো কৌশলগত পরিকল্পনাই নেই’
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এবং সাম্প্রতিক সীমান্ত সংকট নিয়ে বাংলাদেশের যথাযথ কৌশল বা পরিকল্পনা নেই বলে মনে করেন মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক৷
বিজ্ঞাপন
তবে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ মনে করেন আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে একটি দুর্বল অবস্থায় নিয়ে যেতে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পেরেছে৷
সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গোলা একাধিকবার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়েছে৷ ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও৷ নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়েছে কিনা সেটি পরিস্কার নয়৷ তবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যা এসেই পড়ুক তার দায় দেশটির বলে মনে করেন তিনি৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিকভাবে শক্ত জবাব দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি৷
তার মতে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক এই কর্মকাণ্ডের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা সংকট আবার আলোচিত হচ্ছে৷ ‘‘এক্ষেত্রে মিয়ানমার বাংলাদেশের উদ্দেশ্যকে সফল করেছে'', বলেন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা৷
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, শুরু থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল তা দেখাতে পারেনি ঢাকা৷ তার মতে বৈরিতা সত্ত্বেও দুই দেশের সীমান্তরক্ষী ও সামরিক পর্যায়ে যেই যোগাযোগটুকু থাকা প্রয়োজন ছিল সেটি নেই৷
এই আলোচনা এক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গড়ায়৷ শহীদুল হকের মনে করেন, মিয়ানমার এখন সরকারি ও সামরিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল একটি অবস্থায় রয়েছে৷ সেটিকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের যে সমাধান করা যেত তা বাংলাদেশ করতে পারছে না৷ তার মতে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যথাযথ কোনো পরিকল্পনা নেই৷ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আসলেই কি কোন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে? ...প্ল্যান এ এবং প্ল্যান বি যদি না থাকে, আমার কোন স্ট্র্যাটেজি যদি না থাকে তাহলে শুধু আলোচনা দিয়ে রোহিঙ্গার সমস্যার সমাধান হতে পারে না৷’’ তার মতে বাংলাদেশের সীমান্তে মিয়ানমারের অনেক নিরপত্তা দুর্বলতা রয়েছে, সেই সঙ্গে ঢাকা কিছু বাণিজ্যিক সুবিধাও রয়েছে যেগুলোকে ঢাকা কাজে লাগাতে পারছে না৷
তবে তার বক্তব্যের বিরোধিতা করে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, এই ধরনের কূটনৈতিক কৌশল থেকে বর্তমান সরকার সরে এসেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর যাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা আছে তারা হয়ত মিয়ানমারের স্বার্থকে বেশি করে দেখছে, আমাদেরটা কম দেখছে, যে কারণে আমরা তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি৷ এটা হলো বাস্তব সত্য৷''
তার মতে মিয়ানমার সরকার বর্তমানে অর্থনৈতিক সামরিক ও ভূরাজনীতিগত দিক থেকে অনেক দুর্বল অবস্থানে চলে গেছে৷ ‘‘এই দুর্বল অবস্থানে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশ যে কূটনীতি করেছে তার ভূমিকা রয়েছে,'' বলেন এই সামরিক বিশেষজ্ঞ৷
এফএস/জেডএ
রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় যত সমস্যা
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বনভূমি উজাড় হয়েছে, পানির স্তর নীচে নেমে গেছে৷ স্থানীয়ভাবে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা কাজ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
বনভূমির উপর প্রভাব
২০১৯ সালে বনবিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয় কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের কারণে ৮ হাজার একর বন ধ্বংস হয়েছে৷ এরমধ্যে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে ৬ হাজার ১৬৪ একরের উপর৷ আর রোহিঙ্গাদের জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে ১ হাজার ৮৩৭ একর জমি৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
পানির স্তর নেমে যাচ্ছে
বনবিভাগের ঐ রিপোর্টে আরও জানানো হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে এ পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি টিউবওয়েল স্থাপন করতে হয়েছে৷ এ কারণে পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নীচে নামছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অপরাধ
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যের বরাতে সময়নিউজ জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরণের অপরাধে ২ হাজার ৪৩৮টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ১৮৫টি, মাদক উদ্ধার মামলা ১ হাজার ৬৩৬টি৷ ধর্ষণ মামলা ৮৮টি৷ অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায় চেষ্টায় মামলা ৩৯টি৷ ৫ বছরে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১১০টিরও বেশি৷ এসব মামলায় আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার ২২৬ জন৷
ছবি: bdnews24.com
শ্রমবাজারের রোহিঙ্গা
রোহিঙ্গা ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, রোহিঙ্গারা অনেক সময় কম পারিশ্রমিকে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন৷ অনলাইন মিডিয়া ‘সারাবাংলা ডটনেট’ গত এপ্রিলে জানায়, কক্সবাজারের শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিক্ষোভ করেছে ‘কক্সবাজার দিনমজুর ঐক্যপরিষদ’৷ তাদের অভিযোগ, মজুরি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে৷ কিন্তু রোহিঙ্গারা অল্প টাকাতেই কাজে নেমে পড়ছেন৷
ছবি: Guven Yilmaz/AA/picture alliance
হাতির সমস্যা
গত ১১ আগস্ট এক সেমিনারে কক্সবাজার বনবিভাগের দক্ষিণ বিভাগীয় কর্মকর্তা সারওয়ার আলম জানান, কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকায় ৭০ থেকে ৮০টি হাতি রয়েছে৷ এসব হাতি রোহিঙ্গাদের কারণে চলাচলে বাধা পাচ্ছে৷ ফলে মানুষ আর হাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে৷ এছাড়া বনাঞ্চলের নানা স্থাপনা, জবর দখল, রাস্তাঘাট তৈরি হওয়ায় হাতির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে গেছে৷
ছবি: Zobaer Ahmed/DW
বছরে ৩০ হাজার শিশুর জন্ম
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে বলে সরকার জানিয়েছে৷ তাই সেখানে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম আরও জোরদার করতে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএফপিএ-কে অনুরোধ করেছে সরকার৷ পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি বলেন, ‘‘প্রতিবছর যে ৩০ হাজার করে যোগ হচ্ছে, এতে করে ক্যাম্পে ওভারঅল পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে৷’’
ছবি: ED JONES/AFP
‘পরিবেশের যোগ খোঁজা ঠিক নয়’
পরিবেশ, প্রতিবেশের ক্ষতি প্রসঙ্গে শরণার্থী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিক বলেন, ‘‘তারা মানবিক কারণে এখানে আছেন৷ এর সাথে পরিবেশের যোগ খোঁজা ঠিক নয়৷ সারাদেশে বন উজার করা হচ্ছে৷ গাছপালা কাটা হচ্ছে, সেদিকে আমাদের নজর নেই৷ আর নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বাড়িয়ে বলে আসলে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিতদের জন্য বাজেট বাড়ানো হয়৷ তারা ক্যাম্পের মধ্যে থাকেন৷ সেখানে যে পরিবেশে থাকেন তাতে সামাজিক অপরাধ হতেই পারে৷’’