মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (এআরএসএ)-র বার্তায় উজ্জীবিত হচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা৷ তাঁরা বলছেন, সুযোগ পেলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷
দুই সপ্তাহ আগে ২০ বছর বয়সি আইয়ুব রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন৷ কিন্তু এখানকার অনেক রোহিঙ্গার মতো তিনিও নিজ দেশে ফিরে যেতে চান এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী এআরএসএ-তে যোগ দিতে চান৷ এআরএসএ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে৷ আইয়ুব লড়তে চান, কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে দেশছাড়া করেছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এআরএসএ যদি আমাকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় এবং অস্ত্র দেয়, আমি অবশ্যই তাদের সঙ্গে যোগ দেবো৷’’
কেবল আইয়ুব না, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকেই বললেন, সেনাবাহিনীকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার এটাই সঠিক সময়৷ আইয়ুব আরও বললেন, ‘‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শোষণ করে চলেছে৷ তাই এআরএসএ'র প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ যে, তাঁরা আমাদের রক্ষায় এবং আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছে৷ আমি আমার সম্প্রদায়কে বাঁচানোর জন্য লড়াই করতে চাই৷’’
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
সহিংসতার বিরুদ্ধে পাল্টা সহিংসতা:
গত ২৪শে আগস্ট মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ৩০টি থানা এবং পুলিশ ঘাঁটিতে হামলঅ চালায়৷ তাতে ১২ জন নিহত হয়৷ এর পরই লাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী৷ ঐ অভিযানের অংশ হিসেবে জ্বালিয়ে দেয়া হয় গ্রামের পর গ্রাম৷ হত্যা ও নির্যাতন চালানো হয় রোহিঙ্গাদের উপর৷ এমনকি ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে৷ শরণার্থীদের মুখে এসব ঘটনার বিভৎস বর্ণনা শুনেছেন ডয়চে ভেলের প্রতিবেদক৷ এমনই একজন সদু মিয়া জানালেন, সেনাবাহিনী একটি গ্রামের সব তরুণকে ধরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে৷ তিনি তখন জঙ্গলেই এক জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন৷ রাত নামলে তিনি জীবিতদের খোঁজে বের হয়েছিলেন৷ ভাগ্য গুণে যদি তরুণদের কেউ বেঁচে গিয়ে থাকে! কিন্তু তেমন কাউকে পাননি৷ সদু মিয়ার চোখে জ্বলছে ক্ষোভের আগুন৷ জানালেন, ফিরে গিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত তিনি৷ সদু মিয়াসহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বেশিরভাগই পেশায় কৃষক ও জেলে৷ কিন্তু প্রশিক্ষণ পেলে তাঁরা যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত৷
জঙ্গি নাকি মুক্তিযোদ্ধা:
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বা আইসিজি'র তথ্য অনুযায়ী, এআরএসএ বিদ্রোহী নেতাদের সবাই রোহিঙ্গা৷ তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের কোনো যোগসূত্র নেই৷ এদের বেশিরভাগই বড় হয়েছেন সৌদি আরবে৷ ভিডিও বার্তায় এআরএসএ'র বিদ্রোহীরা জানিয়েছেন, তারা জঙ্গি নন, তারা যোদ্ধা, যারা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷
আটে হোয়েকস্ট্রা/এপিবি
প্রিয় পাঠক, আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...