বাংলাদেশে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ শনিবার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ঢাকার অদূরে কাশিমপুর কারাগারে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের খবর ডয়চে ভেলেকে নিশ্চিত করেছেন আইজ প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন৷ পাশাপাশি একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাও ফাঁসি কার্যকরের খবর জানিয়েছে৷ আর কশিমপুর কারগারে সামনে থেকে সাংবাদিক চৌধুরী আকবর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ফাঁসির জন্য কারাগার এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷''
এদিকে জামায়াতে ইসলামী মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করার প্রতিবাদে রবিবার গায়েবানা জানাজা এবং সোমবার সারাদেশে আধাবেলা হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে৷
সাংবাদিক চৌধুরী আকবর হোসেন
কাসেম আলীর দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হল৷ এর আগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে৷
ফাঁসি কার্যকর করার আগে বিকেলে মীর কাসেমের স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয় স্বজনসহ মোট ৩৮ জনকে শেষ বারের মত দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়৷ তারা দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কথা বলা ও দেখা করার সুযোগ পান৷ কাসেম আলীর সঙ্গে দেখা করার পর কারাগার থেকে বের হয়ে তার স্ত্রী সৈয়দা আয়েশা খানম জানান, ‘‘উনি বলেছেন, শেষ মুহূর্তে ছেলেকে দেখতে পারলাম না এই আক্ষেপ রয়ে গেল৷ ছেলে আমার পরিবারে ফিরে আসবে এ প্রত্যাশা করি৷''
আয়েশা খানম আরও জানান, ‘‘তিনি বলেছেন, ‘‘আমি জান্নাতে যাবো৷ আমি আগে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবো৷ তোমরা কান্নাকাটি কোরো না৷ যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি করেছে তারা কখনোই জয়ী হবে না৷ একদিন এই দেশে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা হবেই এবং ইসলামই জয়ী হবে৷''
প্রসঙ্গত, ৩০ আগস্ট মীর কাসেমের আপিল রিভিউ আবেদন খারিজ করে চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ৷ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ থাকলেও শুক্রবার সকালেই তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন৷ তারপরই কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয়া হয়৷ বিচার চলাকালে তিনি এই কারাগারেই ছিলেন৷ আগের পাঁচজনের ফাঁসি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হলেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এখন কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়া হয়েছে৷
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ এরপর গত ৮ মার্চ আপিলের রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে৷ ৬ জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৯ জুন রিভিউ আবেদন আবেদন করেন মীর কাসেম৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আদালতে প্রমাণিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘‘১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে নির্যাতন কেন্দ্র ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়৷ নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়৷'' এই অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ এছাড়া আরো ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডের রায় হয় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে৷
ট্রাইবুন্যালে মামলার শুনানিতে প্রসিকিউটররা মীর কাসেমের অপরাধ সম্পর্কে বলেন, ‘‘এই অপরাধী পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হওয়া এক ‘বাঙালি খান‘ যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷ ডালিম হোটেলকে নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়ে সেখানে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে৷''
উল্লেখ্য, ইসলামী ছাত্রশিবিরের (তত্কালীন ছাত্রসংঘ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, অর্থাত্মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন৷ তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে৷