ঢাকায় আর কোনো যুদ্ধাপরাধীর জানাজা হবে না বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা আইন বিরুদ্ধ বলে দাবি করেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম৷
বিজ্ঞাপন
বলেন, বিশ্বের কোনো দেশে এর নজির নেই৷
মঙ্গলবার চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ২১ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঘোষণা করেন, ‘‘রাজধানী ঢাকার মাটিতে আর কোনো যুদ্ধাপরাধীর জানাজা হবে না৷''
মন্ত্রী বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক মুক্তিযোদ্ধা মুত্যুবরণ করেছেন, শহিদ হয়েছেন৷ তাঁদের শতকরা এক ভাগও জানাজা পাননি; শকুনে, কুকুরে ও শিয়ালে তাঁদের লাশ খেয়েছে৷ নদীতে, খাল-বিলে বা বাগানে সেই লাশ পচেছে৷ তাই ঢাকায় কোনো যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরস জানাজা করতে দেওয়া হবে না৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘আজকে মানবতার কথা আসে, ধর্মের কথা আসে৷ ১৯৭১ সালে আমাদের সহযোদ্ধা মুসলমানরা কেন জানাজা পাননি? তার আগে কৈফিয়ত দেওয়া হোক, বিচার করা হোক৷ তারপর আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি বিবেচনা করব, এর আগে নয়৷''এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ঢাকায় জানাজা পড়তে না দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বেআইনি৷ তিনি এ কথা বলে আইনের লঙ্ঘন করেছেন৷ বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশে এ রকম আইন বা নিয়ম নেই৷ তিনি আইন বিরুদ্ধ কথা বলেছেন৷''
একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি বৃহস্পতিবার রাতে কার্যকর করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো৷ মোল্লার ফাঁসি নিয়ে তৈরি আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
অবশেষে ফাঁসি
৪৮ ঘণ্টা ধরে নানা নাটকীয় পরিস্থিতির পর ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাতে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ এর আগে মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে বিচারকের নির্দেশে তা স্থগিত হয়৷ মোল্লাকে এভাবে ফাঁসি না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, জার্মানি সহ অন্যান্যরা৷
ছবি: picture-alliance/AA
শেষ দেখা
বৃহস্পতিবার ফাঁসির রায় কার্যকরের কিছুক্ষণ আগে কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরিবারের সদস্যরা৷ এসময় জেলগেটে কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বলেন, ‘‘ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই আমার পিতাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Reuters
গ্রেপ্তার, দম্ভোক্তি
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০০৮ সালে ঢাকার একটি থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা৷ পরবর্তীতে কারাগারে দাঁড়িয়ে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘বাংলাদেশ হয়েছে বলে অনেকের মাতব্বরি বেড়ে গেছে৷’’
ছবি: Reuters
যত অভিযোগ
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট ৬টি অপরাধ বিবেচনায় নেয়া হয়৷ এগুলো হলো পল্লবি এলাকার গণহত্যা, কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালিব হত্যা, কেরানীগঞ্জের ভাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড, আলুব্দি গণহত্যা এবং মিরপুরের হযরত আলি পরিবারে গণহত্যা৷ এর সঙ্গে লুটতরাজ, ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগও আছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Archiv Rowshan Jahan Shathi
প্রথমে যাবজ্জীবন, পরে মৃত্যুদণ্ড
ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে কাদের মোল্লার অপরাধ প্রমাণিত হয়৷ এর প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে৷ সেসময় কাদের মোল্লা আদালত থেকে বের হওয়ার সময় ‘বিজয় চিহ্ন’ দেখান৷ এতে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ পরবর্তীতে আপিলের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
দাফন সম্পন্ন
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদুপরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।’’
ছবি: Mustafiz Mamun
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সৃষ্টি হওয়া শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে আবারো ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ৷ মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সেখানে উপস্থিত জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে৷
ছবি: Reuters
‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো’’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো৷ ৪২ বছর পরে হলেও একজন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর হলো৷’’ তিনি আশা করেন, সব যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডই কার্যকর হবে৷
ছবি: privat
জার্মানির প্রতিক্রিয়া
এর আগে, বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তিনি বলেন, ‘‘মন্ত্রীর এ ধরণের কথা উসকানিমূলক৷'' আইন করে যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ঢাকায় জানাজা বন্ধ করা যায় কিনা – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এ ধরণের আইনের কথা হাস্যকর৷ পৃথিবীর কোনো দেশে এ রকম আইন আছে বলে আমার জানা নেই৷'' এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে বলেননি৷ তিনি নিজে থেকেই বলেছেন৷ এর পিছনে সরকাররের আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ বা প্রক্রিয়া স্পষ্ট নয়৷
অন্যদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক স ম রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কথা আমি সরাসরি শুনিনি, সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি৷ তিনি কোন প্রেক্ষাপটে এ কথা বলেছেন, কেন বলেছেন, তাঁর ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারবেন৷ তবে বাংলাদেশের আইনে কোনো জায়গায় কারুর জানাজা নিষিদ্ধ বা বন্ধ করার বিধান নেই৷ এছাড়া এ সবের জন্য আইন করা যায় কিনা – তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ৷''
উল্লেখ্য, গত ২৫শে অক্টোবর জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের জানাজা হয় ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে৷ সেখানে তাঁর জানাজার বিরোধিতা করেছিল গণজাগরণ মঞ্চসহ আরো কিছু সংগঠন৷ তারা প্রতিবাদও জানিয়েছিল৷ কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জানাজায় কোনো বাধা দেয়া হয়নি৷ বরং জানাজার নিরপত্তায় ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়৷ জানাজা নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়ার পর, গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমান আযমি সরকারকে ধন্যবাদও জানান৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৯০ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বন্দি অবস্থায় গোলাম আযম ২৩শে অক্টোবর রাতে মারা যান৷