মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয় ছিলেন প্রবাসী বাঙালিরা
১৫ ডিসেম্বর ২০০৮পাকিস্তানের অংশ হিসাবে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষেরা প্রথম থেকেই সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে৷ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, ভাষা ও সংস্কৃতি সব দিক দিয়েই বাঙালিরা হতে থাকে বৈষম্যের শিকার৷ কিন্তু এত সহজে নত করা যায়নি তাদের৷ বাঙালির ক্ষোভ রূপান্তরিত হয় প্রতিবাদের ভাষায়৷
৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে উচ্চকিত হয়ে ওঠে তাদের সেই প্রতিবাদের ভাষা৷ আত্মদানের মধ্যে দিয়ে ছিনিয়ে আনে তারা ভাষার মর্যাদা৷ তখনই রোপিত হয়ে যায় স্বাধিকারের স্বাধীনতার বীজ৷ অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে অবশেষে সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষেরা শান্তিপূর্ণভাবেই স্বাধিকার আদায় করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি তখনকার পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী৷ কিন্তু রুখে দাঁড়ায় বাংলার মানুষ৷ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে শুরু হয় অসহযোগ সংগ্রাম৷ প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর৷ স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলার মানুষেরা গড়ে তোলে প্রতিরোধ৷ শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ৷ অবশেষে অনেক রক্তদান, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় মহামূল্যবান স্বাধীনতা৷ বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান বাহিনী৷
এই নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করেছেন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা৷ বাইরে থেকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন সারা বিশ্বের প্রবাসী বাঙালিরাও৷ সে সময় ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে গেছেন৷ এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন৷ কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির প্রবাসী বাঙালিরাও যে তখন পিছিয়ে থাকেননি, সেটাই আমরা তুলে ধরব আজ৷
এ প্রসঙ্গে সবার আগে ইউলিখের আনবিক গবেষণা কেন্দ্রের প্রফেসর সুনীল লাহিড়ী, মেঘনাদ শূর, নিখিল ভট্যাচার্য, জহিরুদ্দিন ও দেবব্রত রায়-এর নাম করতে হয়৷ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে পাক বাহিনীর অত্যাচার ও নৃশংসতার খবরে অনেকের মত তাঁরাও ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন৷ কিন্তু নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকতে পারেননি৷ প্রফেসর লাহিড়ির বাসায় বসে তাঁরা মিটিং করে ঠিক করলেন কি করা যায়৷ স্থির করলেন বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে এই যুদ্ধের খবর৷ জার্মানির পত্র পত্রিকায় ছাপাতে শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধের কথা, রেডিও টিভির টকশোতে অংশ গ্রহণ করতেও শুরু করলেন তাঁরা৷ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ এইড কমিটি নামে একটি ম্যাগাজিন৷ তৎপর হন বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফলেট বিলি করতে৷ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জার্মানদের সহানুভুতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এতে৷
এই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি সফরে আসেন৷ জার্মানির বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের কর্মতৎপরতার কথা জানান তাঁকে৷ ‘‘আমাদের বাঁচাও'' এই শিরোনামে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীকে৷
অর্থ সংগ্রহের দিক দিয়েও পিছিয়ে থাকেননি তারা৷ গির্জা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় দু লক্ষ মার্ক সংগ্রহ করেছিলেন সেময়৷এই সময় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে৷ ইউলিখের প্রফেসর লাহিড়ী ও ডুসেলডর্ফের দেবব্রত রায়ের বাসায় বাঙালিদের মিটিংটি হোত নিয়মিত৷ এক মিটিংএ যাওয়ার পথে নিখিল ভট্যাচার্য সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন৷ এই ভাবে প্রবাসী বাঙালিদের আত্মত্যাগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত হতে থাকে৷
কোলন শহরের কয়েকজন বাঙালি তরুণও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে স্থির থাকতে পারেননি৷ কিছু একটা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তারা৷ চাকরীজীবী এই তরুণরা ছুটির পরে সন্ধ্যায় ছুটে যেতেন কোলনের গির্জা চত্বরে কিংবা শিল্ডারগাসে রাস্তার ধারে৷ ছোট টিনের বাক্স নিয়ে পথচারীদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতেন তারা৷ মাঝে মাঝে কোনো কোনো সংস্থার কাছ থেকেও সাহায্য পাওয়া যেত৷ কাপড় চোপড়ের দান সামগ্রী নিয়েও এগিয়ে আসতেন কেউ কেউ৷ এই ভাবে তারা বেশ কয়েক হাজার মার্ক সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদানের কথা বলতে গেলে তখনকার এই সব তরুণদের কথাও স্মরণ করতে হয়, যারা সারাদিন কাজের ব্যস্ততার পর অবসর সময়টুকু ব্যয় করতেন বাংলাদেশে বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রামে শরিক হতে৷