মারা যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)-রা গার্ড অব অনার দিতে পারবেন না-এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক৷
বিজ্ঞাপন
ব্যাপক সমালোচনার মুখে সংসদীয় কমিটিও তাদের সুপারিশ থেকে সরে এসেছে৷
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘‘তারা যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা কোনো প্রস্তাব হলো! ওই প্রস্তাব তো সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক৷ সংবিধানে নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে৷ তাদের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করা তো দূরের কথা, বিবেচনা করারও কোনো সুযোগ নাই৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাকে শেষ বারের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয় গার্ড অব অনারের মাধ্যমে৷ আর সেই সম্মান জানানো উপজেলা বা জেলার প্রাশানিক প্রধানের দায়িত্ব৷ এর সাথে নারী বা পুরুষের কোনো সম্পর্ক নাই৷ আর ধর্মীয় অনুভূতিরও কোনো বিষয় নাই৷ কারণ, গার্ড অব অনার জানাজার নামাজ নয়৷ এটা আলাদা৷’’ প্রস্তাব পাসের সময় অবশ্য মন্ত্রী নিজেও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন৷
ওই প্রস্তাব সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী
এদিকে সংসদসহ নানা মহলের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও তাদের সুপারিশ থেকে সরে এসেছে৷ কমিটিও এখন মনে করে তাদের প্রস্তাব সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ স্থায়ী কমিটির প্রধান শাজাহান খান এমপি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কমিটির একজন সদস্য মেজর(অব.) রফিকুল ইসলাম এমপি বলেছিলেন কয়েকটি উপজেলায় নারী ইউএনওরা গার্ড অব অনার দেয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে৷ আমরা তার কথা পর্যালোচনা করে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম মাত্র৷ আমাদের প্রস্তাব মানতে হবে এমন কোনো কথা নেই৷ আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম বিষয়টি পর্যালোচলার জন্য৷’’
এরইমধ্যে সংসদীয় কমিটি তাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে বলে জানান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি৷ তিনি বলেছেন আমাদের প্রস্তাবটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ আমরা নিজেরাও বুঝতে পেরেছি আমাদের প্রস্তাবটি ঠিক নয়৷ কারণ, এর সাথে ধর্মীয় অনুভূতির কোনো সম্পর্ক নাই৷ গার্ড অব অনার এবং জানাজা এক নয়৷ জানাজা আলাদা পড়ানো হয়৷ তাই আমাদের প্রস্তাবটির এখন আর কোনো অস্তিত্ব নাই৷’’
যে ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলেছিল সংসদীয় কমিটি, তার সঙ্গে ইসলামী চিন্তাবিদরাও একমত নন৷ শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি বা রীতি৷ এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক খোঁজা ঠিক না৷ ইসলামে নারীরা জানাজা বা অন্য কোনো নামাজে ইমমতি করতে পারেন না৷ কিন্তু নিয়ম মেনে নামাজে অংশ নিতে পারেন৷ আর গার্ড অব অনার তো কোনো নামাজ নয়৷’’
সংসদীয় কমিটি এখন তাদের প্রস্তাব থেকে সরে এলেও যারা এই প্রস্তাব করেছেন তাদের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নারী নেত্রী অ্যাডাভোকেট এলিনা খান৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা হয়ত প্রতিবাদের মুখে এখন তাদের অবস্থান বদল করেছেন৷ কিন্তু তাদের প্রস্তাবে নারীর প্রতি তাদের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে৷ যারা আইন প্রণয়ন করেন, তারা যদি সংবিধান না বোঝেন তাহলে তা দুঃখজনক৷ আর তারা ধর্মও জানেন বলে মনে হয় না৷ তাদের এই প্রস্তাব নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায়৷’’
আমরা নিজেরাও বুঝতে পেরেছি আমাদের প্রস্তাবটি ঠিক নয়: শাজাহান খান
গত ১৩ জুন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্ন তুলে গার্ড অব অনারে নারী ইউএনওদের বিকল্পের জন্য প্রস্তাব পাস করে সুপারিশ আকারে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়৷ শাজাহান খান এমপির সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, রাজি উদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, ওয়ারেসাত হোসেন ও মোছলেম উদ্দিন আহমদ৷
প্রসঙ্গত, মৃত্যুর পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেয়ার সর্বশেষ নিয়ামাবলী জারি করা হয় ২০২০ সালে৷ এর আগে ২০১৫ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গার্ড অব অনার দেয়ার বিধান চালু করা হয়৷
নিয়ম অনুযায়ী মহানগর ও জেলা সদরে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকারের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান প্রদর্শন করবেন৷
আর এজন্য মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার কফিন জাতীয় পতাকায় আবৃত করতে হবে৷ তবে সৎকার বা সমাধিস্থ করার আগে জাতীয় পতাকা খুলে ফেলতে হবে৷ সরকারের অনুমোদিত প্রতিনিধি কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন৷ পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা সশস্ত্র সালাম প্রদান করবেন এবং বিউগলে করুণ সুর বাজাতে হবে৷ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গার্ড অব অনার পরিচালনা করবেন৷
একাত্তরের বীর নারীরা
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া, চিকিৎসক ও সেবিকা হিসেবে কাজ করা ছাড়াও অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের বীর নারীরা৷ এমন কয়েকজন অসীম সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনুন৷
ছবি: privat
ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান বীরপ্রতীক
স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সেনা কর্মকর্তা ও চিকিৎসক তৎকালীন সিতারা রহমান৷ তার বড়ভাই মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে নির্মমভাবে খুন হন মেজর হায়দার ৷
ছবি: privat
সিতারার যুদ্ধে যাওয়ার গল্প
জুলাই মাসে ভাই মেজর এটিএম হায়দার আগরতলা যাওয়ার জন্য তার কাছে একটি চিঠি পাঠান৷ চিঠির সঙ্গে ছিল একটি পিস্তল৷ পথে কোথাও পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়লে আত্মহত্যা করার জন্য সে পিস্তল পাঠিয়েছিলেন সিতারা রহমানের ভাই৷ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সামরিক চাকরি উপেক্ষা করে রণাঙ্গনে হাজির ছিলেন ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নেতৃত্ব দেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়৷
ছবি: privat
যুদ্ধাহতের চিকিৎসাসেবা
ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জে ৪০০ শয্যার বাংলাদেশ হাসপাতাল স্থাপন হলে সেখানে চিকিৎসা সেবা শুরু করেন ডা. সিতারা রহমান৷ তার সাথে যোগ দেন আরো বেশ কিছু সাহসী নারী৷ তবে বিজয় পর্যন্ত বাংলাদেশ হাসপাতালের সবকিছু দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ডা. সিতারার উপর৷ সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ এবং ডা. মুবিন ছিলেন৷ বর্তমানে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল সেই উদ্যোগেরই ধারাবাহিকতা৷
ছবি: Dr. Sitara Rahman
কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীরপ্রতীক
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া দুই নারী মুক্তিযোদ্ধার আরেকজন তারামন বিবি৷ মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ১১ নম্বর সেক্টরে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে৷ ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তারামন বিবিকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন৷ কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি৷ ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাকে খুঁজে বের করেন৷
ছবি: Fazle Elahi Shwopon
ছদ্মবেশী তারামন বিবি
সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও শত্রুপক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন তারামন৷ সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন, চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে হাসি-কান্নার অভিনয় করেছেন৷ কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো চলাফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷
ছবি: DW
যুদ্ধজয়ের আনন্দময় মুহূর্তে তারামন
‘‘একদিন দুপুরের দিকে একটা জঙ্গি বিমান এল৷ এই বিমানটা আগের বিমানগুলোর মতো নয়৷ এটা থেকে কোন বোমা ফেলা হলো না৷ শুধু একটা চক্কর দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমরা গুলি ছুঁড়তে চাই৷ কিন্তু বাধা দেন আজিজ মাস্টার৷ ক্যাম্প থেকে আমাদের জানানো হলো, তাদের কাছে খবর এসেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে৷ আনন্দে আমার দুচোখ দিয়ে পানি আসতে শুরু করল৷ ক্যাম্পে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে জয় বাংলা৷’’
ছবি: Fazle Elahi Shwopon
ফোরকান বেগমের সশস্ত্র প্যারেড
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন ফোরকান বেগম৷ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন তিনি৷ ঢাকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন স্বাধিকারের বার্তা নিয়ে৷ ঢাকায় গোয়েন্দাগিরি ও গেরিলা হামলার জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷ আত্মঘাতী হামলার জন্যও কিছু ছেলে-মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷
ছবি: Forkan Begum
ফোরকানের ছবি নিয়ে খুঁজতো পাক বাহিনী
লেম্বুছড়া শিবিরে বাছাই করা আট-দশ জন সাহসী নারীকে নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন ফোরকান বেগম৷ সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যদেরকে দেশের ভেতরে গেরিলা হামলার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন৷ এক সপ্তাহ পরেই তিনি জানান, ফোরকানের ছবি পকেটে নিয়ে তাকে খুঁজছে পাক সেনারা৷ তাই ঢাকায় না পাঠিয়ে ফোরকানের কাছ থেকে দেশের ভেতরে তার প্রশিক্ষিত সঙ্গীদের ঠিকানা নিয়ে তাদেরকে গেরিলা অভিযানে কাজে লাগানো হয়৷
ছবি: Forkan Begum
নার্সিং স্কোয়াডে তাহরীমা
ফোরকান বেগমের কাজে উৎসাহিত হয়ে আগরতলার হাপানিয়া শিবির থেকে অন্য ১৩জন মেয়েসহ তাহরীমা চৌধুরী যোগ দেন জিবি এবং বিএম হাসপাতালের নার্সিং স্কোয়াডে৷ সেখানে তারা সেবিকা হিসেবে কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ ওষুধের মাপ-জোখ, কীভাবে ড্রেসিং করতে হয়, কীভাবে সেলাই করতে হয়, হাড় ভেঙে গেলে কীভাবে প্লাস্টার করতে হয় এসব কিছু শেখানো হয়৷ তখন তার বয়স কেবল ১৪ বছর৷
ছবি: Md Alauddin
রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা
হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত দেহের ছবি এখনও ভেসে ওঠে তাহরীমার চোখে৷ নিজের অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে জানান এভাবে, ‘‘এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি যাদের হাত নেই, চোখ নেই কিংবা পেটের ভুড়ি বের হয়ে গেছে৷ সেখানকার যে আহাজারি, চিৎকার আর কষ্টগুলো দেখেছিলাম এখনও সেগুলো যেন আমার চোখের সামনে ভাসে৷’’
ছবি: Md Alauddin
কৃষক পরিবারের যোদ্ধা শেফালী রানী
গ্রামের এক কৃষক পরিবারে বড় হলেও নিজের দৃঢ় মনোবলের কারণে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মহাবিদ্যালয়ে পা দেন ঝালকাঠির সাহসী নারী শেফালী রানী৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর কলকাতা গিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয় খুঁজে বের করেন তিনি৷ তারপর মতিয়া চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন গোবরা শিবিরে৷
ছবি: Sukanta
লড়াইয়ে সাথী দুই বোন আলো ও মধুমিতা
চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই বোন আলো রানী ও মধুমিতা বৈদ্য৷ তাদের ভাইও মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ি চালাতেন৷ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার সময়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে আলো রানী বলেন, ‘‘বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে আমরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে গিয়ে, তাঁদের দেহ থেকে গুলি বের করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দেখতাম যে খুব কষ্ট হতো আমাদের৷ সেই অবস্থায় মনে হতো যে, হাসপাতালে কাজ না করে অস্ত্র নিয়ে কাজ করাটাই ভালো ছিল৷’’
ছবি: DW
গেরিলা মিনারা
কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত মিনারা বেগম৷ যুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মিনারা ও তাঁর সঙ্গীরা৷ আগরতলা যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিতে গিয়ে ভুল করে ঢুকে পড়েন এলাকার শান্তিবাহিনীর প্রধানের বাড়িতে৷ পরে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার দুই ছেলেকেই মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে রাজি করান মিনারা৷
ছবি: S.Siddiquee
কৌশলে রক্ষা
সেই অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে বলেন মিনারা বেগম, ‘‘আমি এবং ফোরকান বেগম আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি৷ আমরা নরসিংদীর কাছে পাক সেনাদের সামনে পড়ে যাই৷ কিছুক্ষণ পরেই সেখানে গ্রাম পোড়ানোর জন্য যাচ্ছিল পাক সেনারা৷ এর মধ্যেই সেখানে অনেক কৌশল করে রক্ষা পেয়ে যাই৷ সেসময়ও আমাদের ব্যাগে ছোট আকারের গ্রেনেড ছিল৷ আমরা তো আগেই অস্ত্র চালনা শিখেছিলাম৷’’
ছবি: Minara Begum
নয় নম্বর সেক্টর নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধান রমা দাস
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স পড়ছিলেন রমা দাস৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তাঁর লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়৷ ফলে প্রায় প্রতিদিনই কলাভবন, কার্জন হল, শহীদ মিনার চত্বরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন তিনি৷ ফেব্রুয়ারি ও মাচের্র দিনগুলোতে তাঁরা দলবেঁধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতেন৷ এছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখনে অংশ নিতেন৷
ছবি: Pinaki Das
অস্ত্র প্রশিক্ষণ
মাদ্রা প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রমা দাস৷ মেজর জলিল তাকে নয় নম্বর সেক্টরের নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেন৷ দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কথিকা পাঠও করতেন রমা দাস৷ দেশ স্বাধীন হলেও খুলনায় মেজর জলিলের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে থেকে বিভিন্ন কাজ করেছেন তিনি৷
ছবি: Dr. Sitara Rahman
নারী মুক্তিফৌজের সংগঠক নিবেদিতা দাস
সিলেটের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠক নিবেদিতা দাস৷ পাঁচ নম্বর সেক্টরে নারী মুক্তি ফৌজের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি৷ যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের চেলা শিবিরে যান নিবেদিতা দাস৷ কিছুদিন পর জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হক এবং আওয়ামী লীগ নেতা হেমেন্দ্র দাস পুরকায়স্থের সহায়তায় সিলেটের নারীদের নিয়ে নারী মুক্তিফৌজ গঠন করেন তাঁরা৷ এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন প্রীতিলতা দাস পুরকায়স্থ এবং সম্পাদিকা ছিলেন নিবেদিতা দাস৷
ছবি: Rupak Das
মেলাঘর হাসপাতালের দায়িত্বে কাজী হেলেন
১৯৫৪ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জে জন্ম কাজী হেলেনের৷ আগরতলার রাজবাড়িতে কর্নেল রউফ-এর সহায়তায় তিন মাসের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন কাজী হেলেন৷ এরপর তাঁকে জিবি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করা হয়৷ পরে মেলাঘর হাসপাতালের দায়িত্ব পান তিনি৷
ছবি: DW/AHM Abdul Hai
রাজশাহীর গর্ব মুক্তিযোদ্ধা সাবিত্রী বিশ্বাস
বাবার উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ শুরু করেন সাবিত্রী বিশ্বাস৷ আগরতলায় হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমার বাবা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রশিক্ষণ শিবিরের খোঁজ পেয়ে আমাকে নিয়ে সেখানে গেলেন৷ বাবা বললেন, দেশের জন্য কিছু করো মা, না হলে তো হবে না৷ তুমি কি শুধু শুধু বসে থাকবে একা? তখন আমি সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে চিকিৎসা সেবা শুরু করি৷’’
ছবি: Rabiul Anowar Tomy,
‘মুক্তি আপা’ খালেদা খানম
শরীয়তপুরের সাহসী নারী খালেদা খানম৷ তিনি এতোটাই সক্রিয়ভাবে গ্রামে গ্রামে কাজ করতেন যে, শরীয়তপুর অঞ্চলে তাঁকে সবাই ‘মুক্তি আপা’ নামেই চিনতো৷ ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে অস্ত্র খালাসের খবর পেয়ে মিছিল নিয়ে খালেদা ও তার সঙ্গীরা তা ঠেকানোর জন্য রওয়ানা হন৷ কিন্তু কাঁদানে গ্যাস ও গুলির মুখে পড়ে তারা আর এগোতে পারেননি৷ পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন অস্ত্র চালনা ও চিকিৎসার ট্রেনিং৷
ছবি: Nur-A-Ashraful Alam
চিকিৎসার পাশাপাশি যুদ্ধ
ডা. লুৎফুন নেসা বলেন, ‘‘মরিচা হাউসে কাঠের পিস্তল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতাম৷ সেই নমুনা অস্ত্রের বদলে যে একদিন সত্যি আমাদের আসল বন্দুক হাতে নিয়ে লড়তে হবে তা ধারণা করাও কঠিন ছিল৷ তবে পরে যখন কলকাতায় গিয়ে আসল বন্দুক হাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তখন মনে হয়েছে ওরা আমাদের এভাবে মারছে, আমরাও প্রয়োজনে তাদেরকে এই অস্ত্র দিয়ে মারবো৷ চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা তো করবোই, কিন্তু নিজের হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধও আমরা করবো৷’’
ছবি: privat
মুন্সীগঞ্জের বীর ডা. লুৎফুন নেসা
১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন লুৎফুন নেসা৷ একইসাথে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন তিনি৷ সেই হিসেবে চলমান স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি৷ এছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে ইন্দিরা রোডের মরিচা হাউসে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন লুৎফুন নেসা৷
ছবি: privat
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডা. বদরুন নাহার
রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ একাধিকবার তার নৌকা পাক সেনারা আটকও করে৷ তবু নানা কৌশলে তিনি রক্ষা পান পাক হানাদারদের হাত থেকে৷
ছবি: DW
মৌলভীবাজারের নারী নেত্রী রুমা চক্রবর্তী
একাত্তর সালে স্কুল ছাত্রী হলেও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন রুমা চক্রবর্তী৷ এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করেন এই সাহসী নারী৷ মে মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকায় থেকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন৷ পরবর্তীতে ভারতের বনগাঁয় চল্লিশ শয্যার অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে অন্যদের সাথে যোগ দেন রুমা চক্রবর্তী এবং তার বোন৷