মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত
৪ জুন ২০২৫
স্বাভাবিক কারণেই উঠেছে একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রসঙ্গও৷ যারা সরাসরি রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা আর যারা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা করেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।
নতুন করে সংজ্ঞায়নের ফলে অনেক ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা' এখন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীতে পরিণত হলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধাই থাকছেন। কারণ, মুজিব নগর সরকারের সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন নতুন সংজ্ঞায়। কিন্তু মুজিব নগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা' নন।
এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ চার জাতীয় নেতার ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা'র স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুর ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মো. মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বলবৎ থাকবে।”
এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় যাদের পাকিস্তানি হানারদার বাহিনীর এদেশীয় সহযোগী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নাম আছে।
অন্যদিকে নতুন আইনের প্রস্তাবনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মনে করেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া দরকার ছিল, তা না করে নতুন করে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। তারা আরো মনে করেন, প্রস্তাবনা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিসংবাদী নেতৃত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা হয়েছে।
নতুন সংজ্ঞায় যারা বীর মুক্তিযোদ্ধা
অধ্যাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে , "যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তনি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক, উক্ত সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে; এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।”
এছাড়া সংশোধিত সংজ্ঞা অনুযায়ী- হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত নারী বা বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।
আর, মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারীরাও থাকবেন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধে আহত, কিংবা শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়েছেন, সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা ‘শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা'।
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে :
ক) যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
খ) যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
গ) মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; এবং যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন।
ঘ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক।
ঙ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
এই পাঁচটি শ্রেণিতে যারা ছিলেন, তাদের স্বীকৃতি দেয়া হবে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
সংজ্ঞা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বলতে, মুক্তিযোদ্ধার স্বামী বা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা ও মাতা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
একইভাবে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা গণ্য হবেন, তাদের স্বামী বা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা ও মাতা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
প্রস্তাবনায় পরিবর্তন
আইনের প্রস্তাবনায় পরিবর্তন এনে বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী পরিবারে শব্দগুলি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
এর আগে প্রস্তবনায় ছিল, জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখবার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানের সোনার বাংলা গঠন করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।
যেভাবে বিতর্ক শুরু
মঙ্গলবার রাতে অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের একাংশর খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল হয়েছে। তারপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা পর্যায়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
নতুন সংজ্ঞায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা' স্বীকৃত। কিন্তু মুজিবনগর সরকার গঠনে যারা সহযোগিতা করেছেন, সব এমএনএ বা এমপিএ; এবং যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী। একইভাবে মুজিবনগর সরকারের অধীনে কর্মকর্তা বা কর্মচারি বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তারাও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।
আর এখানেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। গণমাধ্যমের একাংশের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের (মুজিবনগর সরকার) রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ-এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বুধবার সচিবালয়ে বলেন, " শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই থাকবেন, আছেন। তাদেরকে বাদ দেয়া হয়নি। বাদ দেয়ার কোনো কারণও নেই”। তিনি অভিযোগ করেন, "নতুন অধ্যাদেশ জারির পর এই বিষয়টি নিয়ে না বুঝেই ভুল ব্যাখ্যা ও বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরও এর ব্যাখ্যা দেয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, "মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং দুই মন্ত্রী মো. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ঠিক নয়।”
‘নতুন করে ফাজলামো শুরু হয়েছে'
বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সেক্টর কমন্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর পর নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা আসলে কোনো সুবিবেচনার কাজ নয়। বিভিন্ন সরকারের সময়ে অমুক্তিযোদ্ধা হয়েও যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন, বরং তাদের যদি চিহ্নিত করা যেতো, সেটা অনেক ভালো কাজ হতো। সেটা না করে নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাল্টানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে।”
"আর এই আইনের প্রিঅ্যাম্বেল থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দেয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, ইতিহাসের পুনর্লিখনের একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নাম প্রিঅ্যাম্বেল থেকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তার অবিসংবাদিত নেতৃত্বের বিষয়টি মুছে ফেলার প্রবণতাই মনে হচ্ছে। এর ফলে আসলে বিভেদ আরো বাড়বে বলে আমি মনে করছি। সময় নিশ্চয়ই প্রমাণ করবে, এই কাজগুলো কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণের বাইরেও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের কাজকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নতুন সংজ্ঞায় তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হয়ে গেলেন। এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
ইতিহাস লেখক, গবেষক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন. "এ নিয়ে নতুন করে আলোচনাটাই জরুরি ছিল না একেবারে। এটা অহেতুক এবং অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা। এদেশে আমার জানা মতে, অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পায়নি। আবার অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রীয় বেতন ভাতা ভোগ করছে। ৫৪ বছর ধরে এটা নিয়ে ফাজলামো হচ্ছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি যে বাড়িতে ভাত খেয়েছি, যে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে সেই অপরাধে তার বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে ওই বাড়ির মালিক মুক্তিযোদ্ধা না? আর যে ভারতে গিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের পর ফিরে এসেছে- সে মুক্তিযোদ্ধা? এই ব্যাপারগুলোর অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। নতুন করে ফাজলামো শুরু হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুর রজ্জাক বলেন," আসলে এখানে সুপরিকল্পিতভাবে এখন অনেক কিছু করা হচ্ছে। আসলে তারা ইতিহাসের সত্য পরিবর্তন করতে চায়। তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি পরিবেশ তৈরি করতে চায়। সে কারণেই এসব করছে। তারা নানা বিতর্ক তৈরি করছে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের নানা ভাগ তৈরি করছে।”
ইতিহাসের দায় ও জামায়াতে ইসলামী
নতুন সংজ্ঞায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং হানাদারদের সহযোগী বা দোসর হিসাবে যাদের নাম এসেছে, তারা হলো: রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটি।
আইনেই বলা হচ্ছে যে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং হানাদারদের সহযোগী ছিল। ফলে, আবারও একাত্তরে তাদের ভূমিকা সামনে এলো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা সেটা প্রশ্ন উঠেছে।
জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারক-ই-আজম ডয়চে ভেলেকে বলেন, " না না, কোনো ব্যবস্থা নেবে না সরকার। আমরা বলেছি এরা ( জামায়াত) ছিল। এটা হিস্টোরিক্যাল এভিডেন্স। ”
কিন্তু তারা তারপরও বাংলাদেশে রাজনীতি করছে এবং এ কারণে এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এটা তাদেরকে (জামায়াত) ব্যাখ্যা দিতে হবে। তারা কেন রাজনীতি করছে, তারা তখন কী করেছিল, তাদের মতামত তো জনগণকে জানাতে হবে। তবে তারা সেই সময়ে পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিল- ইট ইজ ট্রু। এর দায় তো তাদের নিতে হবে।”
শহিদ বুদ্ধিজীবী ও রাজাকারের তালিকা প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এগুলো নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক। আমরা একটা কমিটি করে দিয়েছি যাচাই-বাছাই করার জন্য, তারা দেখছে এটা।”
জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গে ইতিহাস লেখক, গবেষক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন,"এই সরকার জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না, কারণ, এই সরকারের সেই নৈতিক শক্তি বা মনোবল নাই। নৈতিক বল থাকতে হয়, সাহস থাকতে হয়। কার বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবে?”
রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, " আপাতত কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। তবে আলোচনা হবে। বাস্তবতা হলো, ইতিহাস তো মোছা যায় না। আর যতই চেষ্টা করুক, কোথাও না কোথাও আসল সত্য থেকে যায়। যেমন, নতুন আইনে জাময়াতের নাম আছে।”
"আর এই সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না। তারা তো জামায়াতের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে,” বলেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকারের তালিকা এবং অন্যান্য...
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তীব্র সমালোচনার মুখে সেই তালিকা তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, সেই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ স্থগিত করা হয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালের সরকারের হিসেব অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার। ২০২৪ সালে এসে সংখ্যাটা বেড়ে দুই লাখ আট হাজার হয়ে যায়। দুটির পার্থক্য এক লাখ ২২ হাজার হলেও মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মোট ৯০ হাজার।
এ প্রসঙ্গে হারুন হাবীব বলেন, "নতুন আইনে কারা কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, তা বলা হয়েছে। এখন সরকারের উচিত হবে তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা।”
"আর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকাও প্রকাশ করা উচিত। আমি যত দূর জানি, ওই তালিকা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল,” বলেন তিনি।