বাংলাদেশের মুক্ত চিন্তার ওপর এখন আঘাত আসছে দু'দিক থেকেই৷ উগ্রবাদী ধর্মান্ধগোষ্ঠী এখন ‘নাস্তিক-ব্লগার' ছাড়িয়ে লেখক-প্রকাশকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, হত্যা করছে৷ সরকার নানা আইন আর অজুহাতে মুক্তমত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে৷
বিজ্ঞাপন
এ অভিযোগ মানবাধিকার কর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের৷ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে ব্লগার হত্যার আগেই সাহিত্যিকদের ওপর হামলা হয়৷ প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয় ২০০৪ সালে ২৭শে ফেব্রুয়ারি৷ পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান৷ এরপর গত এক বছরে চারজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়৷ সর্বশেষ প্রকাশকদের ওপর হামলা এবং প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হয়৷
আর মঙ্গলবার হত্যার হুমকি দেয়া হয় সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে৷ তিনিসহ ৩৪ জন লেখক ও বুদ্ধিজীবী এই হামলা ও হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে হুমকি দেয়া হয়৷
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার এখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করছে৷ তারা মনে করছে এইসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইনের সুবিধা নিচ্ছে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিরা৷ তবে এর আগে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনসহ চারজন ব্লগারকে আটক করা হয় তথ্য প্রযুক্তি আইনে৷ এই আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম করেছিল উগ্রবাদীরা৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
মানবাধিকার নেতা নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন আর কথিত নাস্তিক ব্লগার নয়, উগ্রবাদীরা প্রকাশক লেখকসহ মুক্তচিন্তার সবাইকে টার্গেট করেছে৷ তারা মূলত দেশে একটা ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাতে চায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনলে আমাদের সামনে আরো খারাপ অবস্থা অপেক্ষা করছে৷ দেশে মুক্ত চিন্তা আজ বিপর্যয়ের মুখে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘অন্যদিকে সরকার আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা দিয়ে মুক্ত চিন্তা, বাক স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে৷ এই আইনের প্রয়োগ করে সরকার তার সমালোচনা বন্ধ করতে চাইছে৷ আর এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন নিয়ন্ত্রণের কথা শোনা যাচ্ছে৷ এটা হলে মুক্তচিন্তা আরো বাধাগ্রস্ত হবে৷'' তাঁর মতে, ‘‘সরকার যতই বলুক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে এটা করা হচ্ছে, বাস্তবে তা নয়৷ বাস্তবতা হচ্ছে সরকার মুক্তচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷''
সরকার কি সত্যিই মুক্তচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়? আপনি কী বলেন? জানান নীচের ঘরে৷