গত ২৮ জুন ঢাকার কামরাঙ্গীচরে ‘সোনার থালা’ নামের একটি রেস্তোরাঁ উদ্বোধনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার কথা ছিল এই শিল্পীর।
স্থানীয় ‘মুসল্লিদের' বাধার মুখে সে অনুষ্ঠানে যেতেই পারেননি অপু বিশ্বাস। এর আগে ২৫ জানুয়ারি জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের টাঙ্গাইল ও কালিহাতী শাখার বাধার মুখে নির্ধারিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি চিত্রনায়িকা পরীমনি। ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর চট্টগ্রামে গিয়েও বাধার মুখে নির্ধারিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি আরেক অভিনয়শিল্পী মেহজাবীন। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি ঘটনাতেই বাধাদানকারীরা স্থানীয় জনগণ এবং তারা ‘তৌহিদী জনতা' বা এ জাতীয় কোনো ব্যানারে সংঘবদ্ধভাবে সংস্কৃতিকর্মীদের বাধা দান করছে।
বাংলাদেশে বাউল উৎসব, কবিগান, যাত্রাপালা বা লোকজ কিছু সাংস্কৃতিক আয়োজনে বাধা দান করার নজির অতীতেও ছিল। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বাউল গানের আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই ‘তৌহিদী জনতা'র চাপের মুখে। আমরা ভুলে যাইনি শরিয়ত বয়াতিকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাঁর গানের জন্য। যদিও এই ধরনের ঘটনায় আমাদের বিনোদন জগতের তারকাদের অধিকাংশই চুপ করে থাকতেন তথাকথিত জনপ্রিয়তার স্বার্থে। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা যখন এ উগ্রবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন করেছি, তখনও রূপালি জগতের বেশিরভাগ শিল্পীই আমাদের সাথে হাঁটেননি। হয়তো ভেবেছিলেন, বাউলের জেল হলে কিংবা যাত্রাপালা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের কী যায় আসে, তারা তো সিলভার স্ক্রিন স্টার!
কিন্তু প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে, অপরাধকে অপরাধ না বললে, অন্যায়কে প্রতিহত না করলে দিনকে দিন তার মাত্রা বাড়তেই থাকে এবং শেষপর্যন্ত সে অন্যায় সবাইকেই ভাসিয়ে নেয়। তখন আর প্রতিবিধান করার মানুষও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এতদিন যে শিল্পীবৃন্দ ভেবেছিলেন, তারা দূর আকাশের তারকা, এ ধরনের ‘স্থানীয় মুসল্লি' কিংবা ‘তৌহিদী জনতা' তাদের বিরুদ্ধে কখনো যাবে না, বা গেলেও তাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই; তারা হয়তো এবার বুঝতে পারছেন, উগ্রবাদ মূলত উগ্রবাদই। ধর্মান্ধতার আগুন কখনো কাউকে ছাড় দেয় না। তাই ধর্মের নামে ছড়ানো এই উগ্রবাদকে শুভবোধ দিয়ে ও প্রকৃত ধর্মের বাণী দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। আর সে লড়াইয়ে সবাইকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর দেশজুড়ে নানা ধরনের তাণ্ডবলীলা আমরা দেখেছি। ভাস্কর্যশিল্প ধ্বংস, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নানামাত্রিক ঘটনা ঘটেই চলছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সংস্কৃতিকর্মীরা কোথাও নিরাপদভাবে তাদের কাজ করতে পারছেন না। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই যে আমাদের চলচ্চিত্র ও নাটকের অভিনয়শিল্পীরা বিভিন্ন জায়গায় তাদের পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মবের শিকার হচ্ছেন এবং অসম্মানিত হয়ে ফিরে আসছেন, তাদের সকলেই কিন্তু নারী। সুতরাং, কেবল যে বিষয়টি সংস্কৃতিকর্মীদের ওপরই আঘাত, তা নয়; এ যেন নারী অভিনয়শিল্পীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করে ফেলারও এক ধরনের চক্রান্ত। আমি জানি না, গত বছরের আগস্টের পর থেকে কোনো পুরুষ শিল্পী এ ধরনের বাধার মুখোমুখি হয়েছেন কি না। সম্ভবত না; কারণ এরকম হলে গণমাধ্যমসূত্রে সে খবরটি জানতে পারতাম। তাহলে এই যে ধর্মীয় ব্যানারের বিভিন্ন সংগঠনগুলো একের পর এক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে এবং নারী শিল্পীদের অবমাননা করছে, এর মূল হেতু কী? এ তো কেবল একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার বিষয়ে পেশাদারিত্বের প্রশ্নই নয়, এর সঙ্গে আমাদের শিল্পীদের নিরাপত্তাও জড়িত। অভিনয়শিল্পী অপু বিশ্বাস, পরীমনি বা মেহজাবীনের সঙ্গে যা ঘটেছে; তা তো কেবল তাদের শিল্পীজীবনের ট্রমাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও। প্রতিটি ঘটনার পর এই শিল্পীরা নিজ নিজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর মৃদু ও কড়া প্রতিবাদ করেছেন। সে সব প্রতিবাদী পোস্টের নিচে যেভাবে অন্যান্য ব্যবহারকারীরা শিল্পীকে অপমানজনক কথা বলেছে, তা কোনো অংশেই কম ভয়ংকর নয়। অভিনয়শিল্পী পরীমনির বিরুদ্ধে তো গ্রেফতারি পরোয়ানাই জারি করা হলো ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর, যদিও পরে আদালতের মাধ্যমে তিনি জামিন নিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একের পর এক নারী শিল্পীদের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে আর কিছুদিন পর বোধ হয় শো-রুম, রেস্তোরাঁ বা এ ধরনের কাজে ব্যবসায়ীরাই আর নারী শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাবেন না। কারণ, যারা ব্যাবসা করছেন, নিজেদের প্রচার-প্রসারের কাজে অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাতে তারও তো লোকসান। সুতরাং এ ধরনের কাজে নারী শিল্পীদের জায়গাটি ক্রমশ আরও সংকুচিত হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
কেবল অভিনয়শিল্পীদের প্রসঙ্গেই নয়; সারাদেশে গত ৫ আগস্টের পর অনেকগুলো কনসার্ট বাতিল হয়ে গেছে। ব্যান্ড শিল্পীদের হাহাকার তাঁদের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত পেয়ে থাকি। কোনো কোনো কনসার্টে উপস্থিত হয়েও ব্যান্ড দলগুলো পরিবেশনা করতে পারেননি। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সেজন্য তারা শ্রোতাদের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেছেন, যদিও এতে ব্যান্ড দলের কোনো দোষ নেই। একই কথা নাটক-চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছ' মাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকলেও বিনোদন জগতের চাকা ক্রমশ পিছনেই ঘুরেছে। অনেকগুলো নাটক-চলচ্চিত্রের শ্যুটিং বন্ধ হয়ে আছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পীরা নানা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই সরকারের। একের পর এক শিল্পীরা বিভিন্ন জায়গায় মবের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু আজপর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ের কাউকে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
ব্যবস্থা নেওয়া তো অনেক পরের কথা। সৈয়দ জামিল আহমেদের মতো নাট্যজন যখন শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব পেলেন, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, এই বুঝি মঞ্চ নাটকের সুদিন ফিরলো। কিন্তু হায়! বাংলাদেশের মঞ্চে সম্ভবত প্রথমবারের মতো নাটক চলা অবস্থায় মহাপরিচালক নিজে গিয়ে সে নাটক বন্ধ করলেন মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হুংকারে ভীত হয়ে। এর চেয়ে লজ্জাজনক কিছুই হতে পারে না। পরবর্তীতে থিয়েটারকর্মীরা যখন এর প্রতিবাদে পথে নামলেন, তখনও সেখানে আক্রমণ করলো মৌলবাদীরা। মামুনুর রশীদের মতো নাট্যব্যক্তিত্ব শিকার হলেন নিগ্রহের। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার মুখে কুলুপ এঁটে রইলো।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। এমনকি নির্যাতন ঘটে যাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। সরকারের এই নির্লিপ্ত নীরবতা সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে যেমন সন্দেহজনক, তেমনি অপরাধীদের কাছে আস্কারা।
সংস্কৃতির রুদ্ধস্বর মুক্ত হোক। ফিরে আসুক আমাদের সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতা।
