রাজনৈতিক নেতারা বিরোধী দলে থাকলে ‘ক্রসফায়ারের' বিরোধিতা করে আর সরকারে থাকলে পক্ষে অবস্থান নেন৷ এতদিন অন্তত এমনটাই হতো৷ কিন্তু এখন তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে৷ ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ-ও এবার এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
সরকারি দলে এই ‘ক্রসফায়ার বিরোধিতা' অবশ্য নতুন কোনো মানবিক চেতনার উন্মেষের কারণে ঘটেছে বলে মনে হয় না৷ এর পিছনে প্রধান কারণ হলো ক্রসফয়ারে শাসক দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনাটি৷ আর যে ক্রসফায়ারটি নিয়ে শাসকদলে বিভক্তি তা হলো ‘আরজু ক্রসফায়ার'৷ গত ১৭ই আগস্ট রাজধানীর হাজারিবাগে চুরির অভিযোগে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ এ ঘটনায় অভিযুক্ত হাজারিবাগ থানা ছাত্রলীগ সভাপতি আরজু মিয়া সেই দিন রাতেই র্যাব-এর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন৷ এই আরজু যে এলাকার ছাত্র নেতা, সেই এলাকার সংসদ সদস্য হলেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, যিনি কিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাত ভাইয়ের ছেলে৷
ফজলে নূর তাপস কোনোভাবেই তাঁর অনুগামী ছাত্রলীগ নেতার এই ক্রসফায়ারকে মেনে নিতে পারেননি৷ তাই তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন৷ সংবাদমাধ্যমে জানান নিজ প্রতিক্রিয়া৷ বলেন, ‘‘এভাবে ক্রসফায়ার মেনে নেয়া যায় না৷''
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
প্রভাবশালী এই সংসদ সদস্য আরজুর ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার পরই পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেয়৷ রবিবার আরজুর রড় ভাই মাসুদ রানা ঢাকার সিএমএম আদালতে র্যাব ২-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ রানা, র্যাব ২-এর ইন্সপেক্টর শাহিদুর রহমান, ইন্সপেক্টর ওয়াহিদুজ্জামান এবং র্যাব-এর সোর্স রতনকে আসামি হত্যা মামলা দায়ের করেন৷ তার আগে ঐ বন্দুকযুদ্ধের পরদিন, অর্থাৎ ১৮ই আগস্ট, হাজারিবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাঈনুল ইসলামকে বদলি করা হয়৷ এখানেই শেষ নয়৷ র্যাব-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ রানাকেও প্রত্যাহার করা হয় সোমবার৷
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘‘আরজুর ক্রসফায়ারের ঘটনা অনুসন্ধানে প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে৷ র্যাব-এর অপরাধ থাকলে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে৷''
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের দাবি, ‘‘র্যাব ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটনায় না৷'' বলা বাহুল্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী র্যাব-এর অভিভাবক৷ তিনি তো এ কথা বলবেনই৷ অথচ এর আগে তিনি বলেছিলেন,‘‘অপরাধী ধরতে গেলে দু-একটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটতেই পারে৷''
২০০৪ সালে র্যাব যখন প্রতিষ্ঠা হয়, সে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি৷ তখন বিএনপি সরকার র্যাব-এর ক্রসফায়ারের পক্ষেই ছিল৷ বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ছিল ক্রসফায়ার বিরোধী৷ মানবাধিকার সংগঠন-এর হিসাব অনুযায়ী, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ১,৬৫৩ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷ এছাড়া চলতি বছরে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৬৭ জন৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে, নিহতদের মধ্যে বড় একটি অংশ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী৷ আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী৷ যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তখন ক্রসফয়ারের শিকার হন তাদের বিরোধী পক্ষের সদস্যরা৷ তাই প্রচলিত নিয়মে সরকার ক্রসফায়ারের পক্ষে আর বিরোধীরা বিপক্ষে৷ তবে এবার তার কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেল৷ কারণ ক্রসফায়ারে পড়ে গেছেন সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের নেতারা৷ এঁদের মধ্যে একজন আবার সরকার দলীয় অতি প্রভাবশালী এক সংসদ সদস্যের অনুগামী৷
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
কিন্তু র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সতস্যদের এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো শুরু থেকেই অবস্থান নিয়েছে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো একাধিকবার র্যাব-এর কার্যক্রম বন্ধ অথবা পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও র্যাব-এর এই ধরণের কর্মকাণ্ড বন্ধের কথা বলেছে৷ কিন্তু সরকার চাপে থাকলেও তা আমলে নেয়নি৷
অভিযোগ, গত বছরের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং একজন আইনজীবীসহ সাতজনকে হত্যা করে র্যাব৷ তারা নিহতদের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বিপূল পরিমান টাকা নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়৷ ঐ ঘটনাতেও প্রথমে দায়ী র্যাব সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হয়নি৷ পরে অবশ্য ব্যাপক প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে দায়ী র্যাব অধিনায়কসহ অন্য র্যাব সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ তদন্তে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় আদালতে এরইমধ্যে চার্জশিটও দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু প্রতিবাদ এবং চাপ না থাকলে কী হত তা বলা মুশকিল৷ দায়ী র্যাব সদস্যরা আদৌ আইনের আওতায় আসতেন কিনা আমি নিশ্চিত নই৷ এখানেও নিহতদের মধ্যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম শাসক দল আওয়ামী লীগের একজন নেতা৷ তাই হয়ত ‘মানবাধিকার' রক্ষা হয়েছে৷
কিন্তু এই একটি-দু'টি ঘটনায় বিচার বা তদন্তে কী হবে! প্রায় দুই হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার বা তদন্ত কে করবে? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকার বিরোধী, বেআইনি৷ তাই এটি হত্যাকাণ্ডই৷ কোনো আইনে বা বিবেচনাতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা বা দায়ীদের দায়মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই৷ তাই প্রতিটি ঘটনার তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন৷
যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়েইন এখন ঢাকা সফর করছেন৷ তিনি মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ৷ এখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ ও মেনে চলা জরুরি, তার অর্থ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ্য করা যায় না৷ একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না৷''
তার মানে ক্রসফায়ার বন্ধ করেই এখন বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে৷ নয়ত মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কোনো লাভ নেই৷
সরকারি দলের অথবা সরকারি দলের প্রভাবশালী কোনো নেতার অনুসারীকে ক্রসফায়ারে দিলে ক্রসফায়ার অবৈধ হবে আর বিরোধী বা সাধারণ মানুষকে ক্রসফায়ারে দিলে তা ‘বৈধ' হবে – এ কেমন কথা! মনে রাখা ভালো, ‘দানব' কারুর বন্ধু হতে পারে না৷ একদিন সে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে মালিককেই হয়ত বধ করবে৷