ইতিহাস থেকে মুঘল ঐতিহ্য মুছে দেওয়ার আরো এক নিদর্শন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল গার্ডেনের নাম বদলে দেওয়া হলো।
বিজ্ঞাপন
দিল্লির রাইসিনা হিলে ভারতের রাষ্ট্রপতির বাসভবন। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই ভবনের নির্মাণ করেছিলেন ইউরোপের বিখ্যাত স্থপতি এডউইন লুটিয়েনস। রাষ্ট্রপতি ভবনের অন্যতম আকর্ষণ প্রায় ১৫ একর জমির উপর তৈরি মুঘল গার্ডেন। প্রতিবছর নির্দিষ্ট কয়েকমাসের জন্য যা খুলে দেওয়া হয় সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্যেও। সেই বাগানের নাম রাতারাতি বদলে দেওয়া হলো। রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, এখন থেকে বাগানের নাম 'অমৃত উদ্যান'। কেন এই নাম পরিবর্তন করা হলো, তার অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে শাসকদল বিজেপি অনেকদিন ধরেই বলছে, দেশের ইতিহাস নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। উপনিবেশবাদের ইতিহাস বদলে দেওয়া হবে। তারই অন্যতম উদাহরণ এই নামবদল বলে মনে করা হচ্ছে।
দিল্লির সরকারি ভবন বানরদের দখলে
01:41
প্রশ্ন হলো, কেন রাষ্ট্রপতি ভবনের বাগানের নাম মুঘল গার্ডেন রাখা হয়েছিল? মুঘলরা তো এই বাগান তৈরি করেনি! বরং ব্রিটিশ স্থপতির পরিকল্পনায় বাগান তৈরি হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের বক্তব্য, মুঘলদের বাগান তৈরির কিছু নির্দিষ্ট ভাবনা ছিল। পারস্যের অনুপ্রেরণায় যে স্থাপন কৌশল তারা তৈরি করেছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনের বাগান সেই স্থাপত্য কৌশলের উপরেই দাঁড়িয়ে। বস্তুত, জম্মু-কাশ্মীরের মুঘল বাগান, তাজমহলের মুঘল বাগানের অনুকরণে রাষ্ট্রপতি ভবনের বাগান তৈরি করা হয়েছিল। পার্রস্যের মিনিয়েচার ছবির অনুপ্রেরণাও আছে ওই বাগান নির্মাণে। শুধু তা-ই নয়, মুঘল স্থাপত্য কৌশলে তৈরি বাগানে ফুল গাছ লাগানো হয়েছিল ইউরোপীয় কায়দায়। ফলে ঐতিহাসিকভাবে এই বাগানের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রণব মুখোপাধ্যায়: কীর্ণাহার থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন
বীরভূমে কীর্ণাহার গ্রামে জন্ম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। সেখান থেকে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কাহিনি চমকপ্রদ।
ছবি: AP
শুরু বাংলা কংগ্রেসে
প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু কংগ্রসে নয়। অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেস থেকে। ১৯৬৯ সালে বাম সমর্থিত বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে তাঁর রাজ্যসভায় প্রবেশ। কিছুদিনের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়ে যান। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর থেকে তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের শুরু।
ছবি: Reuters
মন্ত্রী প্রণব
রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার চার বছরের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হলেন প্রণব। ১৯৭৩ সালে তিনি শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের ডেপুটি মিনিস্টার বা উপ মন্ত্রী হন। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু পর্যন্ত প্রণববাবু রাজনীতিতে দ্রুত উঠে এসেছেন৷
ছবি: UNI
ইন্দিরা গান্ধীর অর্থমন্ত্রী
জরুরি অবস্থার সময়েও মন্ত্রী ছিলেন প্রণব। পরে '৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তোলার পরে অনেক কংগ্রেস নেতা দল ছেড়েছিলেন। কিন্তু দুঃসময়ে ইন্দিরার পাশে ছিলেন প্রণব। আবার ইন্দিরা ক্ষমতায় এলেন ১৯৮০তে। দুই বছর পরে ১৯৮২ সালে প্রণববাবু পেলেন অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব। ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভায় অঘোষিত দুই নম্বর স্থানে চলে এলেন প্রণব।
ছবি: UNI
তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধি
প্রণববাবু জননেতা ছিলেন না। দীর্ঘদিনের সাংসদ, জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান নেতা হলেও পশ্চিমবঙ্গে আমজনতার মধ্যে প্রণববাবুর যে ভয়ঙ্কর জনপ্রিয়তা ছিল তা নয়। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সাফল্যের পিছনে ছিল তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধি, ঠিক পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা, সংবিধান, সংসদীয় রীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান এবং যে কোনো সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার কৌশল ঠিক করার ক্ষমতা।
ছবি: AP
ক্ষমতার বাইরে
দেহরক্ষীদের গুলিতে মারা গেলেন ইন্দিরা গান্ধী। রাজীব গান্ধী তখন পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন। দিল্লি ফেরার সময় বিমানে প্রণবের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এরপর কার প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত? তাঁর জবাব ছিল, অতীতে দুই বারই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর সব চেয়ে প্রবীণ মন্ত্রী হয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে রাজীবেরই হওয়া উচিত। কংগ্রেসে গুঞ্জন উঠল, প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রী হতে চান। পরে রাজীবের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হলো না তাঁর।
ছবি: AP
নিজের দল গড়লেন
রাজীব গান্ধীর আমলে কংগ্রেসে অবহেলিত হলেন প্রণববাবু। প্রথমে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ পড়লেন। তারপর তাঁকে ছয় বছরের জন্য দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। নিজের দল গড়লেন প্রণব। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। পরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল খুব খারাপ ফল করল। প্রণব তো জননেতা ছিলেন না। তাঁর জোরের জায়গা ছিল প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধি।
ছবি: AP
আবার কংগ্রেসে
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আবার কংগ্রেসে ফেরা ১৯৮৮ সালে। তখন বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজীব কোণঠাসা। সে সময় আবার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজীব গান্ধীর সম্পর্ক ভালো হলো। তিনি দলে ফিরলেন। ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব পেলেন এবং দলকে জেতালেন।
ছবি: DW
এ বার বিদেশমন্ত্রী
নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হলেন ১৯৯১ সালে। তিনি প্রণববাবুকে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান করলেন। পরে তিনি মন্ত্রিসভায় নিলেন প্রণববাবুকে। ১৯৯৫ সালে প্রণববাবু বিদেশমন্ত্রী হলেন।
ছবি: UNI
ইউপিএ-র কান্ডারী
ইউপিএ আমলে আবার ক্ষমতার শিখরে প্রণব মুখোপাধ্যায়। মনমোহন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় আবার দুই নম্বর ব্যক্তি প্রণব। সরকারে বা দলে সমস্যা হলেই ভরসা প্রণব। একগুচ্ছ মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধান। বামেদের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী। আন্না হাজারে থেকে রামদেবকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের দায়িত্বে। আর ২০০৪ সালে প্রথমবারের জন্য লোকসভায় জিতে আসতে পারলেন প্রণববাবু।
ছবি: AP
প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি
২০১২ সালে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়ে রাইসিনা হিলসের প্রসাদোপম রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেলন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন কপি বুক রাষ্ট্রপতি। পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রপতি থেকেছেন বিতর্কহীন হয়ে। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। মনমোহন বিদায় নিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী এসেছেন। কিন্তু প্রণবের সঙ্গে সকলেরই সম্পর্ক ছিল অসাধারণ। পরে তাঁকে ভারতরত্নে সম্মানিত করেন মোদী।
ছবি: picture alliance/Photoshot/Bi Xiaoyang
আরএসএসের অনুষ্ঠানে
তিনি বরাবর সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শের সমালোচনা করে এসেছেন। কিন্তু সেই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আরএসএসের অনুষ্ঠানে দেখা যাওয়ায় কংগ্রেসিরা অবাক হয়েছিলেন।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
রাজনৈতিক যুগের অবসান
প্রণবের চলে যাওয়ার ফলে ভারতে অবসান হলো একটা রাজনৈতিক যুগের। বীরভূমের কীর্ণাহার থেকে এসে দেশের সর্বোচ্চ পদে বসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই উত্থান ভারতীয় গণতন্ত্রের জয়৷
ছবি: UNI
12 ছবি1 | 12
ইতিহাসবিদদের একাংশের বক্তব্য, রাতারাতি বাগানের নাম বদলে ইতিহাস নষ্ট করা হয়েছে। দ্য ওয়্যারে বিশিষ্ট লেখক উরবিশ কোঠারি লিখেছেন, ''সর্ব অর্থেই ইতিহাস নষ্ট করা হয়েছে।'' তার বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি ভবনের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাচ্ছে, বাগানের উপর কার্সার নিয়ে গেলে 'অমৃত উদ্যান' লেখা ফুটে উঠছে। সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি। সেখানে প্রণববাবুর উদ্ধৃতির মধ্যেও অমৃত উদ্যান শব্দটি আসছে। যেন, প্রণববাবু অমৃত উদ্যান শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতি বাগানকে মুঘল গার্ডেনই বলেছিলেন। উরবিশ মনে করেন, এ-ও একধরণের ইতিহাস বিকৃতি।
বিজেপির নেতারা অবশ্য একে কোনোভাবেই ইতিহাসের বিকৃতি বলে মনে করেন না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং বলেছেন, ''দেশ বদলাচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।'' আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু টুইট করেছেন, 'এই নাম পরিবর্তন নতুন ভারতের অন্যতম প্রতীক।'
বিরোধীরা অবশ্য নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করছেন। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন বলেছেন, ''কে বলতে পারে, এবার ইডেন গার্ডেনের নাম বদলে রাখা হবে মোদী উদ্যান। কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের জন্য কাজের ব্যবস্থা করুক। মুদ্রাস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করুক।'' সিপিআই-য়ের সাধারণ সম্পাদক ডি রাজার প্রশ্ন, ''ইতিহাস বিকৃতির এই প্রবণতা কবে বন্ধ হবে?''