মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুরসি-কে বিশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে৷ আবার একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়, বলে মনে করেন রাইনার সলিচ৷
বিজ্ঞাপন
এই রায় কি বড়ই নরম, নাকি অত্যন্ত কড়া? রায় ঘোষণার পর পরই তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কে নেমেছেন মিশরীয়রা৷ সাবেক জেনারেল এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল-সিসি-র কট্টর সমর্থকরা মুরসি-কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন৷
মুরসি-র মুসলিম ব্রাদারহুড-কে ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে৷ তারা বলছে ‘‘সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের দ্বারা মিশরে গণতন্ত্রকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের'' কথা – যদিও মুরসি-কে আদর্শ গণতন্ত্রী বলে গণ্য করার কোনো কারণ নেই৷ অপরদিকে মিশরের বর্তমান শাসকরাও আদর্শ গণতন্ত্রীর তকমা দাবি করতে পারেন না৷ ফৌজি হর্তাকর্তারা ২০১৩ সালে একটি অংশত সাজানো গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসি-কে ক্ষমতাচ্যুত করেন৷
মিশরে রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি
হোসনি মুবারক বিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে কম সময়ই শান্তির সুবাতাস বয়েছে মিশরে৷ মুরসিকে হঠানোর আন্দোলন শুরুর পর থেকে বিক্ষোভের আগুন নেভেইনি৷ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি৷ এ নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: imago/Ralph Peters
ধুঁকছে পর্যটন
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পর্যটন শিল্পের৷ দেশের জিডিপিতে ছয় ভাগের এক ভাগ অবদান রাখে পর্যটনশিল্প৷ বৈদেশিক মুদ্রা আসে প্রচুর৷ কিন্তু প্রায় দু’বছর ধরে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকায় পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷ বেশ কিছু ট্র্যাভেল এজেন্সি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিশরে তাদের কাজ বন্ধ রেখেছে৷ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে মিশরে যাওয়ার ব্যাপারে জার্মান নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কৃষিখাতে বিপর্যয়
মিশর থেকে তেল, পোশাক এবং কৃষিপণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এসব খাতে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ৷ কিন্তু রাজনীতির মাঠে অস্থিরতা, সহিংসতা কালো থাবা ফেলেছে খাদ্য এবং কৃষিখাতে৷ রপ্তানি করা দূরের কথা, এ বছর উল্টে কৃষিপণ্য আমদানিও করতে হতে পারে মিশরকে৷
ছবি: Mohammed Hossam/Afp/Getty Images
সুয়েজ নিয়ে মাথাব্যথা
সুয়েজ খালের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহের রুট নিয়ন্ত্রণ করে মিশর৷ সুয়েজ খালে সেনাপ্রহরা রয়েছে৷ তারপরও ক্ষতি রোধ করা যাচ্ছে না৷ তেলের দাম বাড়ছে হু হু করে৷ এ মুহূর্তে দাম গত পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
বন্দরগুলোও সংকটে
কায়রো থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব পোর্ট সাঈদ৷ মিশরের খুব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর৷ দেশের প্রায় সবগুলো বন্দরেই চলছে বিশৃঙ্খলা, উত্তেজনা৷ পণ্য পরিবহন অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শিল্প এবং খনন শিল্প
এই দুটি শিল্পের অবস্থাও খুব খারাপ৷ এই দুটো খাত থেকেও আয় কমছে৷ মিশরের জনসংখ্যা ৮ কোটি ৪০ লাখ, যা কিনা জার্মানির চেয়েও বেশি৷ কিন্তু ২০১২ সালে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল জার্মানির দশ ভাগের এক ভাগের মতো৷ পার্থক্যটা এখন যে আরো বাড়ছে তাতে আর সন্দেহ কী!
ছবি: Khaled Desouki/Afp/Getty Images
রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত
২০১১ সাল থেকেই চলছে রাজনৈতিক সংকট৷ নানা জায়গায় রেল লাইন উপড়ানো হয়েছে বহুবার৷ সংকট শুরুর পর থেকে পাঁচ শতাংশেরও কম পণ্য পরিবহন হয়েছে রেলপথে৷ কায়রো থেকে আলেক্সান্দ্রিয়া এবং সুয়েজ খালের কাছের রেল পথ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের৷ অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: imago/Arnulf Hettrich
বেহাল সড়কপথ
৪৫ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সড়কপথ রয়েছে মিশরে৷ কিন্তু সংকট শুরুর আগে থেকেই দেশের অর্ধেকেরও বেশি সড়কপথের জরা-জীর্ণ অবস্থা৷ জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা দরকার৷ কিন্তু বিক্ষোভ আন্দোলন সে কাজ শুরুই করতে দিচ্ছে না৷ নতুন মোটরপথ তৈরির পরিকল্পনাও ফাইলবন্দি৷
ছবি: Fayez Nureldine/Afp/Getty Images
বিদেশি কোম্পানির পিছটান
কায়রোতে বেশ ভালো ব্যবসা করছিল জার্মানির চেইন শপ ‘মেট্রো’৷ সম্প্রতি মিশরে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে তারা৷ মিশরের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার জার্মানির আরো তিনটি বড় বাণিজ্যিক সংস্থা সরে এসেছে সে দেশ থেকে৷ বিএএসফ, থাইসেনক্রুপ আর হেঙ্কেল নিজেদের কর্মীদের ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে মিশর থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিমান চলাচলে বিলম্ব
বিমানে দেরিতে যাত্রা শুরুর ব্যাপারটি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে মিশরে৷ সময় মতো যাত্রা শুরু করতে চার ঘণ্টা আগে গিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হতে হচ্ছৈ যাত্রীদের৷ এত কঠোর নিরাপত্তা তল্লাসি চলছে যে তার জন্য বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে সবাইকেই৷ জার্মানির লুফৎথানসা এয়ারওয়েজ অবশ্য এখনো কায়রোতে যাওয়া-আসা করছে৷ তবে অনেক দেশের বিমান মিশরে যাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অলাভজনক হয়ে পড়ায় ফ্লাইট বাতিল করতে শুরু করেছে৷
ছবি: imago/Ralph Peters
9 ছবি1 | 9
আরো মামলা ঝুলছে
অবশ্য মুরসি-র বিচার প্রক্রিয়ার এখানেই সমাপ্তি নয়, আরো চমক আসতে পারে, কেননা ৬৩ বছর বয়সি মুরসি-র বিরুদ্ধে অন্তত তিনটি আরো মামলা ঝুলছে৷ তবে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের দরুন৷ একাধিক মানুষকে হত্যা, অথবা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকার অভিযোগ অপ্রত্যাশিতভাবে বাতিল করা হয়েছে৷
সাক্ষ্যপ্রমাণের পর্যালোচনা না করেই বলা যায় যে, এই রায় আদালতের অপরাপর রায়ের মতো নয়৷ প্রথমত, এই রায় প্রাক্তন সামরিক শাসক হোসনি মুবারকের বেকসুর খালাসের তুলনায় অতিমাত্রায় কঠিন৷ অপরদিকে এও আশ্চর্য যে, মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক ছোটখাটো কর্মীদের ইতিপূর্বে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে – অথচ মুরসি-কে দেওয়া হল বিশ বছরের কারাদণ্ড৷
পশ্চিমে সমালোচনার ঝড় ওঠেনি
মুরসি-কে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার কারণ সম্ভবত মিশরের পররাষ্ট্র নীতিগত পরিস্থিতি৷ মুরসি-কে ক্ষমতাচ্যুত করার বিরুদ্ধে গোড়ায় পশ্চিমি সরকারবর্গ কিছুটা সমালোচনা ব্যক্ত করলেও, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তারা আরব বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল দেশটির সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহী৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় সামরিক সাহায্য শুরু করেছে, প্যারিস কায়রোর সঙ্গে একটি বিপুল অঙ্কের অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আল-সিসি-কে বার্লিনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ মুরসি-কে আরো কড়া সাজা দিলে মিশরের সঙ্গে নতুন করে দহরম-মহরমে ব্যাঘাত ঘটতে পারত৷ ওদিকে মিশরের অর্থনীতির নাটকীয় পরিস্থিতের ফলে কায়রোর শাসকবর্গ এখন পশ্চিমের মদত পেতে আকুল৷
মুরসি-র বিরুদ্ধে রায় তুলনামূলকভাবে কঠিন না হলেও, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবাধিকার সংস্থা মুরসি-র বিচার প্রক্রিয়াকে ন্যায় এবং আইনের শাসনের উপযোগী বলে মনে করেনি৷ বিগত কয়েক বছরে মিশরে যে ক'টি রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ মামলা সংঘটিত হয়েছে, তাদের সব ক'টিতেই অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণিত বলে গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে৷
ন্যায়বিচারের কী হল?
এখন বোঝা যাচ্ছে যে, মিশরের আইন বিভাগ শুধু সরকারের বাধ্যই নয়, বরং চতুর এবং সর্বাঙ্গীণ রাজনৈতিক আবহাওয়া অনুযায়ী নড়ে-বসে৷ এর মূল শিকার হচ্ছে ন্যায়বিচার: মিশরে গত কয়েক বছরের নাটকীয় ঘটনাবলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ মুরসি-র পতনের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের বিক্ষোভ দমন করা হয় শক্ত হাতে: তাতে প্রাণ হারান অন্তত ৬০০ জন৷
অথচ এই সব মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের মৃত্যুদণ্ড অথবা কারাদণ্ডের কোনো আশঙ্কা নেই৷ আল-সিসি-র রাজত্বে তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না, কেননা তারা বর্তমান ক্ষমতার কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷