লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়েছে কারাগারে৷ একই মামলায় এখনো কারাবন্দি কার্টুনিস্ট কিশোর৷ ডিজিটাল আইনের অপ্রয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে সোচ্চার হয়েছে অনেকেই৷ এ আইন বিলুপ্তিরও দাবি উঠেছে৷
বিজ্ঞাপন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যখন প্রণীত হয়, তখন থেকেই এই আইন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে৷ কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে এ আইন নিয়ে সমালোচনার মাত্রা আরো বেড়েছে৷ ঢাকায় সাংবাদিক সঞ্জয় দে ফেসবুক বার্তা দিয়েছেন এভাবে-
‘‘আইনে জামিন-অযোগ্য ধারা যুক্ত করা পুরোপুরি অসাংবিধানিক৷ তারপরেও সরকার বিভিন্ন আইনে এটা রাখে প্রথমত, জনগণকে তুষ্ট রাখতে (যেমন, নারী নির্যাতন দমন আইন) এবং দ্বিতীয়ত, নিজেদের স্বার্থে (যেমন আইসিটি আইন)৷ এই জামিন-অযোগ্য ধারার বিপুল অপপ্রয়োগ হয় বিচারিক আদালতে মামলা চলার সময় এবং এর শিকার মূলত ক্ষমতাহীন-দুর্বল পক্ষ৷’’
মুশতাকের মৃত্যুর পর মনে হচ্ছে এ আইন রাখার উপযোগী না: কাওছার শাকিল
একই যুক্তি দেখিয়ে ‘কালাকানুন’ বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি তুলেছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ও অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট৷ তারা ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকেই মুশতাকের মৃত্যুতে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলন করছে৷ প্রতিবাদী মশাল মিছিল শেষ করে এসে অনলাইন অ্যাক্টিটিভিস্ট ও লেখক কাওছার শাকিল জানালেন, কিছুদিন আগ পর্যন্তও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনই যথেষ্ট মনে করতেন তিনি৷ কিন্তু মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর মনে করছেন এ আইন রাখার উপযোগী না, কারণ, আইনটি থাকলে এর অপব্যবহার হবেই৷
অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আসার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্যাটায়ারের পরিসর অনেক সীমিত, এমন অভিযোগও সামনে এসেছে৷ তাই রাজনৈতিক স্যাটায়ার করার প্রবণতাও আগের তুলনায় কমে গেছে বলে তিনি মনে করেন৷ কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকের সাপ্তাহিক রঙ্গ-ব্যাঙ্গাত্মক ক্রোড়পত্র বন্ধ পর্যন্ত হয়ে গেছে৷ এ প্রসঙ্গে কথা হয় লেখক ইমন চৌধুরীর সঙ্গে৷ একাধিক জাতীয় দৈনিকে রঙ্গ-ব্যাঙ্গাত্মক লেখা, কার্টুন সম্পাদনার অভিজ্ঞতা থাকা এই সাংবাদিক বলেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক মহলে অনেক আলোচনা আছে৷ এটা কঠোর হলে বা নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে সরকারের অবশ্যই দেখা উচিত৷ আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই সময়ে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের সহনশীল আচরণ কাম্য৷ আবার জনগণের দিক থেকেও বাক স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই বলা ঠিক হবে না৷ দুপক্ষ থেকেই একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে৷’’
সোশ্যাল মিডিয়ার এই সময়ে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের সহনশীল আচরণ কাম্য: ইমন চৌধুরী
কার্টুনিস্টকিশোরের মুক্তি দাবি
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ গ্রেপ্তারের পর থেকেই তাদের মুক্তির দাবিতে অনলাইনে সোচ্চার ছিলেন অনেকে৷ গতকাল থেকে কার্টুনিস্ট কিশোরের মুক্তির দাবি আরো প্রবল হয়েছে৷ তার শারিরীক অবস্থাও ভালো নয়- এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে৷
অন্যদিকে মুশতাকের মৃত্যুতে কারা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি আছে কিনা, তা তদন্ত করার দাবিও তুলেছে আন্দোলনকারীরা৷ এরই মধ্যে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি অবস্থায় মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণ জানতে ‘প্রয়োজনে’ তদন্ত কমিটি করা হবে৷ তবু মাঠ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে আন্দোলনকারীরা৷ ১ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও করার ঘোষণা দিয়েছে তারা৷ তার আগে গণজমায়েত কর্মসূচিও চলতে থাকবে৷ এসব কর্মসূচি প্রসঙ্গে অনলাইন অ্যাক্টিটিভিস্ট ও লেখক কাওছার শাকিল ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে বলেন, কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সরকার একটা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করুক, যার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রতিকার হবে৷
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷