সাবেক বসনিয়ান সার্ব কমান্ডার রাটকো ম্লাদিচের বিরুদ্ধে বুধবার জাতিসংঘের বিচারকরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন৷ প্রায় আট হাজার মুসলিম হত্যায় দণ্ডিত করা হয়েছে তাকে৷
বিজ্ঞাপন
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে বসনিয়ার স্রেব্রেনিৎসা শহরে রাটকো ম্লাদিচের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে ঘটা সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বলে পরিচিত এটি৷
বুধবার ম্লাদিচের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফর্মার ইয়োগোশ্লাভিয়া' বা আইসিটিওয়াই-এর বিচারকরা৷ এই সময় ম্লাদিচকে স্রেব্রেনিৎসা হত্যাকাণ্ডসহ মোট দশটি অপরাধে দণ্ডিত করা হয়৷ এর মধ্যে গণহত্যা ছাড়াও আছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ৷
আইসিটিওয়াই-এর বিচারক আলফোনস ওরি বলেন, ‘‘স্রেব্রেনিৎসায় পুরুষ ও তরুণদের হত্যা এবং নারী, বালক ও কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য করে ম্লাদিচ স্রেব্রেনিৎসা থেকে বসনিয়ান মুসলমানদের নির্মূল করতে চেয়েছিলেন৷’’
আদালতে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণার আগে ম্লাদিচ ‘বিচারকরা মিথ্যা বলছেন’ বলে চিৎকার করতে থাকলে তাঁকে আদালত কক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়৷
রায় ঘোষণার সময় আদালতের বাইরে নিহতদের আত্মীয়রা ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ স্বামী, বাবা ও সন্তান হারানো নেদজিবা সালিহোভিচ বলেন, ‘‘ম্লাদিচ দ্য হেগে মারা যাবে৷ ন্যায়বিচার হওয়ায় আমি খুব খুশি৷’’
এদিকে, মাদার্স অফ স্রেব্রেনিৎসা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুনিরা সুবাসিচ জানান, ম্লাদিচের বিরুদ্ধে দেয়া রায়ে তিনি ‘আংশিক খুশি’, কারণ, কয়েকটি গ্রামে গণহত্যা চালানোয় ম্লাদিচকে অভিযুক্ত করা হয়নি৷
তবে ম্লাদিচের রায়ে রাদোভান কারাজিচের বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন সুবাসিচ৷ কারণ, ম্লাদিচের মতো একই রকম অভিযোগে অভিযুক্ত কারাজিচকে গত বছর ৪০ বছরের সাজা দেয়া হয়৷
প্রতিক্রিয়া
‘বসনিয়ার কসাই’ ম্লাদিচের বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের পর সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুচিচ তাঁর দেশের নাগরিকদের অতীত নিয়ে পড়ে না থেকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে বলেছেন৷ একই রকম বক্তব্য শোনা গেছে বসনীয় মুসলমানদের নেতা বাকির ইজেৎবগোভিচের কণ্ঠে৷ সার্বদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘সত্যকে স্বীকার করাই একমাত্র রাস্তা, একমাত্র উপায়৷ তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অতীতের চেয়ে ভালো হবে৷’’
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে’ বলকান অঞ্চলের দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷ জাতিসংঘ রায়কে ‘ন্যায়বিচারের পক্ষে অবিস্মরণীয় বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে৷ যুক্তরাষ্ট্র বলকান অঞ্চলের সবাইকে একত্র হয়ে ঐ অঞ্চলের উন্নতির জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে৷ জার্মানিও রায়কে স্বাগত জানিয়েছে৷
জেডএইচ/এসিবি (এএফপি, রয়টার্স)
বলছি এক গণহত্যার কথা
১৯৯৪ সালের এপ্রিলে আফ্রিকার রুয়ান্ডায় চালানো হয়েছিল এক গণহত্যা৷ মাত্র একশো দিনে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় আট লক্ষ মানুষ৷
ছবি: Alexander Joe/AFP/GettyImages
প্রেসিডেন্টের হত্যা দিয়ে শুরু
১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল অজ্ঞাত হামলাকারীরা রুয়ান্ডার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে৷ এতে হাবিয়ারিমানা ও তাঁর সঙ্গে থাকা বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সহ আরও আটজন নিহত হন৷ এর পরদিন থেকেই শুরু হয় গণহত্যা৷
ছবি: AP
গণহত্যার কারণ
নিহত হওয়া প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা হুটু জনগোষ্ঠীর সদস্য৷ তাঁর সরকার টুটসি সম্প্রদায়ের দল ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ (আরপিএফ)-এর সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করেছিল৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়েছিল উগ্র হুটুরা৷ এঁদের মধ্যে সরকারে থাকা অনেক সৈন্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন৷ ফলে উগ্রবাদীরা ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য গণহত্যায় অংশ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
একশো দিনে আট লাখের প্রাণ!
প্রায় ১০০ দিন ধরে চলা গণহত্যায় প্রাণ যায় প্রায় আট লক্ষ মানুষের৷ উগ্রপন্থি হুটুরা পরিকল্পনা করে টুটসি সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করা শুরু করে৷ যেসব হুটু এই হত্যাযজ্ঞের বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরও মেরে ফেলে হুটু উগ্রবাদীরা৷ মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, রাজনীতিক কেউ রেহাই পায়নি৷ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘জেনোসাইড ফ্যাক্স’
১৯৯৪ সালের এপ্রিলে গণহত্যা শুরুর তিনমাস আগে জাতিসংঘে একটি সতর্কবাণী পাঠিয়েছিলেন রুয়ান্ডা বিষয়ক জাতিসংঘ মিশনের কমান্ডার রোমিও ডালেয়ার৷ কিন্তু সে সময় তাঁর কথা শোনা হয়নি৷ এই সতর্কবার্তাটি সেসময় ‘জেনোসাইড ফ্যাক্স’ নাম পেয়েছিল৷
ছবি: A.Joe/AFP/GettyImages
গির্জায় গণহত্যা
রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির কাছের একটি গির্জায় প্রায় চার হাজার পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল৷ দা, ছুরি ও কুড়াল দিয়ে তাদের মারা হয়৷ এখনো ঐ গির্জায় গেলে কঙ্কাল, মানুষের শরীরের হাড় ও দেয়ালে বুলেটের আঘাত দেখতে পাওয়া যাবে৷
ছবি: epd
ফ্রান্সের ভূমিকা
রুয়ান্ডার হুটু সরকারের সঙ্গে ফ্রান্সের ভালো সম্পর্ক ছিল৷ তাই গণহত্যা শুরুর দুই মাসের মাথায় সেদেশে সেনাবাহিনী পাঠায় ফ্রান্স৷ ফরাসি সেনারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত রুয়ান্ডার সৈন্য ও জঙ্গিদের প্রতিবেশী দেশ জাইর (বর্তমানে ডিআর কঙ্গো) পালিয়ে যেতে সহায়তা করে৷ এই মানুষগুলো এখনো রুয়ান্ডার জন্য হুমকিস্বরূপ৷
ছবি: P.Guyot/AFP/GettyImages
লক্ষ লক্ষ শরণার্থী
গণহত্যা থেকে বাঁচতে লক্ষ লক্ষ টুটসি ও হুটু দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী তানজানিয়া, জাইর ও উগান্ডায় পালিয়ে গিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজধানী দখল
হুটুরা গণহত্যা শুরু করার পর টুটসি বিদ্রোহীদের দল আরপিএফ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে৷ অবশেষে তারা রাজধানী কিগালির নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয়৷
ছবি: Alexander Joe/AFP/GettyImages
গণহত্যা যেভাবে শেষ হয়
কিগালির দখল নেয়ার পর আরপিএফ নেতা মেজর জেনারেল পল কাগামে ১৯৯৪ সালের ১৮ জুলাই যুদ্ধ শেষের ঘোষণা দেন৷ এর মধ্য দিয়ে তিন মাস ধরে চলা গণহত্যার সমাপ্তি ঘটে৷ উল্লেখ্য, ২০০০ সাল থেকে কাগামে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷