প্রথমবারের মতো না হলেও, ব্রাসেলসের হামলা কিছু কঠিন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যার উত্তর পশ্চিমা বিশ্বকে অবশ্যই দিতে হবে৷ এ সব প্রশ্নের উত্তরে দরকার আত্ম-অনুসন্ধান, লিখেছেন ডয়চে ভেলের গ্রেহেম লুকাস৷
বিজ্ঞাপন
তরুণ মুসলমানরা কেন তাদের সমাজের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছে এবং ঠান্ডা মাথায় স্বদেশিদের হত্যা করছে? ইউরোপে জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়দার ইন্ধনে হামলার শুরুর পর থেকেই এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমরা৷ এখনও হামলা অব্যাহত আছে৷ তবে এখন মাঠে হাজির তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট' বা আইএস-এর অনুসারীরা৷ ব্রাসেলস বিমানবন্দর, মোলেনবেক সাবওয়ে স্টেশন এবং নভেম্বরের প্যারিস হামলার পর প্রশ্নটির উত্তর জানা জরুরি হয়ে পড়েছে৷ আর এরকম প্রাণহানি থামাতে চাইলে ইউরোপীয় সমাজকে দ্রুত কার্যকর কিছু করতে হবে৷ তবে অল্পতে সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না৷
একটা গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর' হচ্ছে, তরুণ মুসলমানদের ইউরোপের সমাজের সঙ্গে একাত্ম করতে ইউরোপীয়দের ব্যর্থতা৷ অবশ্যই এটার দু'টো দিক রয়েছে৷ অনেক অভিবাসী, তা তারা যে ধর্মেরই হোন না কেন, ইউরোপের মূল সমাজের সঙ্গে একাত্ম হতে খুব কমই আগ্রহ দেখিয়েছেন৷ তারা বরং সমাজের মূলধারা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন৷ তারা ব্রাসেলসের মোলেনবেকের মতো মহল্লায় দলবেধে বাস করছেন, যেখানে প্যারিস হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আবদেসালাম থাকতেন৷ ফ্রান্স, ব্রিটেন আর জার্মানিতেও এরকম অভিবাসীদের মহল্লার গড়ে উঠছে, যা সবাই দেখছেন৷
যে রাত বিশ্বকে বদলে দিল
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ১৩ই নভেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ১২৯ জন নিহত ও ৩৫২ জন আহত হয়েছে৷ কেঁপে উঠেছে গোটা বিশ্ব৷ বদলে গেছে অনেক কিছু৷
ছবি: Reuters/C. Allegri
প্রাথমিক খবর
জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন প্যারিসে হামলার প্রাথমিক খবর আসতে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মানুষের মনে ভয়
খবর পেয়ে প্যারিসের মানুষের মনে ভয় ও আতঙ্ক ছেয়ে যায়৷ কর্তৃপক্ষ মানুষকে বাড়িতেই থাকার পরামর্শ দিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পণবন্দি নাটকের মঞ্চ
বাটাক্লঁ কনসার্ট হলে হেভি মেটাল সংগীত চলাকালীন সন্ত্রাসবাদীরা কিছু মানুষকে পণবন্দি করেছিল৷ রাত একটা নাগাদ পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে৷
ছবি: Reuters/C. Hartmann
বিহ্বল প্রেসিডেন্ট
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদ টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন৷ ফুটবল ম্যাচের বিরতির সময়ে তিনি স্টেডিয়াম ছেড়ে গিয়েছিলেন৷ তাঁকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়৷
ছবি: Reuters
স্টেডিয়ামে চাপা আতঙ্ক
ফ্রান্স ও জার্মানির জাতীয় দল এবং দর্শকরা কিন্তু স্টেডিয়াম ছেড়ে যাবার অনুমতি পাননি৷ সে সময়ে তাঁদের মনের অবস্থা কী ছিল, তা অনুমান করা যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Alexandre
হামলাকারীদের দশা
প্রায় সব আততায়ী নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে৷ একজন সীমান্ত পেরিয়ে বেলজিয়ামে প্রবেশ করেছে৷ পুলিশ সূত্র অনুযায়ী হামলাকারীদের মধ্যে কমপক্ষে দু’জন বেলজিয়ামে বসবাস করতো৷
ছবি: Getty Images/K. Tribouillard
আহতদের অবস্থা সংকটজনক
প্যারিসে একাধিক হামলায় আহত অনেক মানুষের অবস্থা সংকটজনক৷ ফলে নিহতদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Bureau
কড়া নিরাপত্তার বেড়াজাল
প্যারিসে হামলার পর আন্তর্জাতিক স্তরেও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে৷ যেমন নিউ ইয়র্কে ফরাসি কনসুলেটের সামনে আরও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
গোটা বিশ্বে সংহতি
নিউ ইয়র্কে ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’-এর অ্যান্টেনায় ফরাসি জাতীয় রং ফুটিয়ে তোলা হয়৷ নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো বলেন, ‘‘আমরা ফরাসি জাতির সঙ্গে সংহতির বন্ধনে আবদ্ধ৷’’
ছবি: Reuters/C. Allegri
9 ছবি1 | 9
সমাজের মধ্যে বিভেদের এক মূল কারণ অভিবাসীদের যে দেশটি তারা আছেন, সেদেশের ভাষা আয়ত্ত্ব করতে না পারা৷ ফলে তারা যে দেশে আছেন সেদেশের মূলধারার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হতে পারেন না৷ আর এটা এক মৌলিক সমস্যার সৃষ্টি করে৷ অভিবাসী পরিবারের সন্তানরা যেদেশে আছেন সেদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পুরোপুরি সুবিধা নিতে পারেন না, কেননা সাফল্যের জন্য যতটা ভাষা তাদের শেখা দরকার, ততটা তারা আয়ত্ত্বে আনতে পারেন না৷
পশ্চিমা সমাজের চাকুরিব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবেই কর্মক্ষমতা নির্ভর৷ চাকুরিদাতারা সেসব প্রার্থীদের গুরুত্ব দেন যাদের ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে এবং কঠোর পরিশ্রম ও প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের অংশীদার হতে আগ্রহী৷ ফলে যারা স্কুলে খারাপ ফলাফল করছেন কিংবা লেখাপড়া শেষ করছেন না তারা ডারউইনীয় নীতি অনুসারে বাদ পড়ে যাচ্ছেন৷ আর এটাই পুঁজিবাদী সমাজের ধরন৷ অভিবাসী সমাজের অনেক তরুণ ছেলে-মেয়েই কম-বেতনের চাকুরি করেন কিংবা বেকার থাকায় নিন্দিত হন৷ কেউ কেউ একপর্যায়ে বেকারভাতা নির্ভর জীবনযাপনের অভ্যস্ত হয়ে পড়েন৷ আর এ সব ঘটে তাদের বেলায় যারা সমাজের মূলধারায় ভিড়তে পারেন না৷
এরকম পরিস্থিতিতে পরা তরুণরা যদি তখন ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের খপ্পরে পড়েন তখন পরিস্থিতিটা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়৷ উগ্র ইসলামপন্থি মতাদর্শ হচ্ছে সর্বগ্রাসী৷ ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়া উগ্রপন্থিরা তাদের মতাদর্শের সঙ্গে পশ্চিমের উদার নীতিতে বিশ্বাসী সমাজের সংঘাত দেখতে পায়৷ ফলে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট'-এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা অবিশ্বাসীদের উপর সন্ত্রাসী হামলাকে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়৷
জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং বেলজিয়ামের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর সবাই দেখেছে কিভাবে অসন্তুষ্ট তরুণ মুসলমানরা আইএস-এ যোগ দিতে সিরিয়া যাচ্ছে৷ তারা বিশ্বাস করে ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের হত্যা করার মাধ্যমে তারা এক আজগুবি খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারবে, যা আসলে মারাত্মক ভুল ধারণা৷ তারাও এটাও মনে করে, সেখান থেকে ফিরে এসেছে ইউরোপে হামলার মাধ্যমে তারা মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য জায়গায় ‘ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদের' প্রতিশোধ নিতে পারবে৷ আর এটাই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি৷
জার্মানিতে কয়েকজন শরণার্থীর জীবন
যুদ্ধবিক্ষুব্ধ কোনো দেশ থেকে কীভাবে ইউরোপে আসছে লক্ষ লক্ষ মানুষ? সবাই কি স্থায়ীভাবে ইউরোপে থাকতে চান? থাকতে হলে কী করতে হবে? কী করছেন তাঁরা? কয়েকজন শরণার্থীর জীবন দেখে একটু ধারণা নেয়া যাক৷
চিকিৎসক থেকে শরণার্থী
সিরিয়ায় রাজধানী দামেস্কে চিকিৎসক হিসেবে ভালোই ছিলেন হামবার আল-ইসা৷ কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর জন্মভূমির সব সুখ ছেড়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে হয় তাঁকে৷
অনেক পথ পেরিয়ে...
মেসিডোনিয়ায় পৌঁছানোর পর সার্বিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছে হামবারকে৷ হেঁটে কোনো শহরে পৌঁছালেই শুরু হতো ইন্টারনেট ক্যাফে খুঁজে বের করার চেষ্টা৷ পেলে প্রথম কাজ কোথায় আছেন, কেমন আছেন সে সম্পর্কে পরিবারকে বিস্তারিত জানানো৷ একা এসেছেন, তাই স্বজনদের তাঁর জন্য খুব চিন্তা৷ তাঁদের চিন্তা দূর করা ও তাঁদের সম্পর্কে জেনে নিজেকে নিশ্চিন্ত রাখতেই পছন্দ করেন হামবার৷
অবশেষে জার্মানিতে...
অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে জার্মানিতে পৌঁছেছেন হামবার৷ সিরিয়াতে সার্জন হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নতুন দেশে চাইলেই তো আর চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করা যায় না৷ জার্মান ভাষা শিখে নিজেকে তৈরি করতে হবে সবার আগে৷ সেই চেষ্টা চলছে৷ পাশাপাশি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অনুবাদকের কাজও করছেন৷ তাঁর স্বপ্ন অবশ্য জার্মানিতে বসবাস করা নয়৷ সুসময় ফিরে এলে নিজের দেশেই ফিরতে চান হামবার৷
দেশান্তরী এক আফগান কিশোরী
তোবার বয়স এখন ১৬ বছর৷ আফগানিস্তানের হেরাত থেকে জার্মানিতে এসেছে সে৷ হেরাতে নিয়মিত স্কুলে যেত সে৷ লেখাপড়া করেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নও দেখতো৷ কিন্তু তালেবান বেছে বেছে মেয়েদের স্কুলে হামলা শুরু করায় তোবার পক্ষেও আর দেশে থাকা সম্ভব হয়নি৷
সপরিবারে জার্মানিতে
আফগানিস্তান থেকে জার্মানিতে অবশ্য একা আসেনি তোবা৷ দুই বোন এবং তাঁদের স্বামীও এসেছেন সঙ্গে৷ কাছের এই মানুষগুলো সঙ্গে থাকার কারণেই ইরান, তুরস্ক, গ্রিস এবং বলকান অঞ্চল হয়ে জার্মানিতে পৌঁছাতে পেরেছে তোবা৷
দুঃস্বপ্নে পোড়া স্কুল, স্বপ্নে সুন্দর আগামী
তালেবান হামলা থেকে বাঁচতে আফগানিস্তান ছেড়ে এলেও স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন কিন্তু ছাড়েনি তোবা৷ নিজেকে নতুন করে তৈরি করছে সে৷ জার্মান ভাষা শিখছে৷ স্বাবলম্বী হতে হলে জার্মানিতে ভাষা শেখাটা তো সবার জন্যই জরুরি৷
এক সাংবাদিকের পরিবার
ওপরের ছবির তিনজন জার্মানিতে এসেছেন সিরিয়ার ইদলিব থেকে৷ আহমেদ (মাঝখানে)-এর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী হেবা এবং বন্ধু সালেহ৷ সিরিয়ায় সাংবাদিক হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন আহমেদ৷
শৈশবেই প্রবাসী
আহমেদ-হেবা দম্পতির এই মেয়েটিও এসেছে জার্মানিতে৷ মাত্র এক বছর বয়সেই শুরু হয়েছে তার প্রবাসজীবন৷ ওর বাবা অবশ্য যুদ্ধ থামলেই ফিরে যেতে চায় সিরিয়ায়৷
8 ছবি1 | 8
আমরা অবশ্যই নিশ্চিত থাকতে পারে যে, পশ্চিমা সমাজগুলো নিরাপত্তা বাড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করবে৷ ইউরোপে পুলিশের পেছনে খরচও ব্যাপক বাড়ানোর আশা আমরা করতে পারি৷ এগুলো ঠিক এবং দরকার৷ নিরাপত্তা আমাদের অধিকার৷ তবে আমাদের আরো কিছু করা উচিত, এবং দ্রুত৷ অভিবাসীদের, তা তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন, সমাজের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে আরো উদ্যোগী হতে হবে৷ কেননা, আমাদের অর্থনীতির ভালোর জন্য তাদের দরকার৷ আমাদের আরো নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং চাকুরিক্ষেত্রে সমান অধিকার পাচ্ছে৷ আর এ জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ এবং নতুনভাবে ভাবতে হবে৷ আমরা সেটা না করলে অসন্তুষ্ট মুসলিম তরুণদের সংখ্যা আরো বাড়বে, যাদের কাজে লাগিয়ে উগ্রপন্থিরা আমাদের উদার সমাজে হামলার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা ধ্বংস করতে চাইবে৷ আর তাতে সকলেরই ক্ষতি৷
বন্ধু, আপনি কি গ্রেহেম লুকাসের সঙ্গে একমত? আপনার মন্তব্য জানান, নীচের ঘরে৷