সান ফ্রান্সিসকোর পর জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে শুরু হতে যাচ্ছে ইসলামিক ফ্যাশন প্রদর্শনী, যাকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
মুসলিম নারীদের ফ্যাশন সচেতন করে তুলতে ফ্রাংকফুর্টের আঙভান্ডটে কুন্সট জাদুঘরে শুরু হচ্ছে বিশেষ এক প্রদর্শনী৷ প্রথমবারের মতো এমন প্রদর্শনীর আয়োজনকে ঘিরে বরাবরের মতোই মুসলিমদের পোশাক নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ এটি নারীদের অপমান হিসেবে অভিহিত করে বিরোধীতা করছেন নারীবাদীরা৷ আর আয়োজকরা বলছেন পশ্চিমা বিশ্ব যেই ফ্যাশন দুনিয়াকে উপেক্ষা করে আসছে তা সবার সামনে তুলে ধরাই তাদের উদ্দেশ্য৷
হালের মুসলিম ফ্যাশন
ইসলাম ও হালের স্টাইল? এই দুইয়ের সমন্বয় অনেকের কাছে সমস্যার মনে হতে পারে৷ তবে ইসলামি রীতি-নীতি মেনেই মুসলিম নারীর ফ্যাশন কীভাবে সম্ভব, তারই প্রদর্শনী হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর ডে ইয়াং মিউজিয়ামে৷
ছবি: Sebastian Kim
পরিশীলিত থেকেই আধুনিকতার ছোঁয়া
প্রদর্শনীতে হাল আমলের মুসলিম স্টাইল ও পোশাক তুলে ধরা হয়৷ তারই একটি ছিল মালয়েশিয়ার খ্যাতনামা ডিজাইনার বার্নার্ড চন্দ্রনের সিল্ক ও সারোভস্কির ক্রিস্টাল দিয়ে এই উপস্থাপন৷ যেসব ফ্যাশন নিয়ে অনেক কথা হয় কিন্তু সেগুলো উপস্থাপনের তেমন সুযোগ হয় না, সেগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় এখানে৷
ছবি: Fine Arts Museums of San Francisco
জাকার্তা থেকে নিউ ইয়র্ক
পশ্চিমা ফ্যাশন জগতেও সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে ডিয়ান পেলাঙ্গির মুসলিম ফ্যাশন৷ ২৭ বছরের এই তরুণী সেই গুটিকয়েক মুসলিম ফ্যাশন ডিজাইনের একজন, যিনি লন্ডন, মিলান ও নিউ ইয়র্কের ক্যাটওয়াকসে নিজের কাজ তুল ধরতে পেরেছেন৷
ছবি: Fine Arts Museums of San Francisco
রাজনৈতিক বার্তা
ইসলামভীতি দূর করতে ভূমিকা রাখার একটা প্রচেষ্টাও ছিল সান ফ্রান্সিসকোর এই প্রদর্শনীতে৷ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আরবি হরফে ছাপা হয় জ্যাকেটের গায়ে৷ অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথাও বলা হয় এই সংশোধনীতে৷ এই জ্যাকেটের ডিজাইন করেছেন লেবাননের সেলিনে সিমান ভারনন৷ উনিশ শতকের আশির দশকে শরণার্থী হিসেবে বাবা-মার সঙ্গে ক্যানাডায় এসেছিলেন তিনি, পরে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে৷
ছবি: Sebastian Kim
ট্রাম্পের ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞার’ জবাব
রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশে ডিজাইনকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেলিনে সিমান৷ ২০১৭ সালে তিরি তৈরি করেন ‘ব্যানড’ স্কার্ফ৷ এ সব স্কার্ফের কোনো কোনোটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া দেশগুলোর স্যাটেলাইট ছবি তুলে ধরেন তিনি৷ এই ছবিতে মডেল হিসেবে আছেন ইরানি-অ্যামেরিকান পলিটিক্যাল ফ্যাশন ব্লগার হোডা কাতেবি৷
ছবি: Fine Arts Museums of San Francisco/Driely Carter
স্পোর্টস ফ্যাশন
পোশাক, জ্যাকেট ও রাজনৈতিক বার্তাবাহী স্কার্ফের পাশাপাশি স্পোর্টস ফ্যাশনও উঠে আসে প্রদর্শনীতে৷ এ ধরনের ফ্যাশন পণ্যগুলোর মধ্যে নাইকির হিজাব এবং আহেদা জেনেট্টির আলোচিত সাঁতারের বিকিনি ছিল৷ ২০১৬ সালে এই বিকিনি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছিল ফ্রান্স সরকার৷
ছবি: DW/A. Binder
স্থাপত্যবিদ্যার প্রতীকী ক্ষমতা
এই প্রদর্শনীর ডিজাইন করেছে দুই ইরানি-অ্যামেরিকান বোনের নেতৃত্বাধীন নিউ ইয়র্কভিত্তিক আর্কিটেকচার ফার্ম হারিরি অ্যান্ড হারিরি৷ দর্শনার্থীকে বিস্তৃত পরিসর দেওয়ার পাশাপাশি তার রহস্য উন্মোচনের উপলব্ধি লাভের বিষয়টি মাথায় রেখে এই ডিজাইন করা হয়৷ ২০১৯ সালের বসন্তে এই প্রদর্শনী আবার হবে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট আম মাইনে৷
ছবি: DW/A. Binder
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক: প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম
অগণিত ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট ও ফ্যাশন ম্যাগাজিন মুসলিম ফ্যাশন জগতের জন্য নিবেদন হয়েছে৷ ইনস্টাগ্রামে গতানুগতিক হেডস্কার্ফকে অত্যাবশ্যক ফ্যাশন হিসেবে উদযাপন করেছে কথিত ‘হিজাবিস্টাস’৷ এই দিকটিও ‘কনটেমপোরারি মুসলিম ফ্যাশনস’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে৷ সান ফ্যান্সিসকোতে আগামী ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে প্রদর্শনী৷
ছবি: DW/A. Binder
7 ছবি1 | 7
‘কনটেম্পরারি মুসলিম ফ্যাশন এক্সিবিশন' বা সমসাময়িক মুসলিম ফ্যাশন নামের প্রদর্শনীটি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর একটি জাদুঘরে আয়োজন করা হয়েছিল৷ সেখানে হিজাব ও বোরকাকে ঘিরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নের জবাব দেয়া এই আয়োজনের উদ্দেশ্য নয় বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা৷‘‘প্রদর্শনীর মূল বিষয় ফ্যাশনেবল শালীন পোশাক৷ আমরা দেখানোর চেষ্টা করছি যে মুসলিম নারীদের জন্যও এ ধরণের অনেক কিছু রয়েছে,'' বলেন প্রদর্শনীটির কিউরেটর জিল ডি আলেসান্দ্রো৷
৮০ ধরণের স্টাইলের পোশাক নিয়ে এই প্রদর্শনীটি আয়োজিত হবে৷ যার অনেকগুলোই মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ডিজাইনারদের কাছ থেকে নেয়া৷ ‘কাফতান', ‘হেডস্কার্ফ'সহ বিভিন্ন রঙিন পোশাকের পাশাপাশি সেখানে বোরকা, নাইকির তৈরি ‘স্পোর্টস হিজাব'-এরওদেখা মিলবে৷
হুমকি
মঙ্গলবার শুরু হতে যাওয়া এই প্রদর্শনী ঘিরে এরইমধ্যে ঘৃণা ছড়ানো মেল পেতে শুরু করেছেন প্রদর্শনীটির জার্মান সমন্বয়করা৷ যার কারণে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ প্রদর্শনীর সময় ব্যাগ ও শরীর তল্লাশির ব্যবস্থা চালু করেছে৷ ‘‘এটি সব দর্শনার্থীর ও কর্মীদের নিরাপত্তার জন্যই,'' জার্মান সংবাদ সংস্থা ডিপিএকে জানিয়েছেন জাদুঘরের পরিচালক মাটিয়াস ভাগনার৷
অন্যদিকে ‘মাইগ্রেন্টস ফর সেক্যুলারিটি অ্যান্ড সেলফ ডিটারমিনেশন' নামের একটি দল জার্মান নারীবাদী ম্যাগাজিন ‘এমা'তে খোলা চিঠি লিখেছেন৷ তাঁরা এই আয়োজনে হতভম্ব হয়েছেন বলে জানান৷ ‘‘প্রদর্শনীর মাধ্যমে ফ্যাশনে ধর্মীয় পোশাকের প্রয়োজন তুলে ধরা হচ্ছে৷ এটি দেশ এবং বিদেশের নারী অধিকার কর্মীদের গালে চড় বসানের মতো ঘটনা,'' বলে লিখেছেন তাঁরা৷
মুসলিম মেয়েদের সাঁতার শেখা সহজ করছে জার্মানি
সাঁতার জানা প্রতিটি মানুষের জন্যই জরুরি৷ তাই ধর্ম বিশ্বাসের কারণে সাঁতার শেখা থেকে মুসলিম মেয়েরা যাতে বিরত না থাকে, সেজন্য জার্মানির একটি স্কুলে তাদের ‘বুর্কিনি’ পরে সাঁতার শেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Rolf Haid
কোনো কারণেই শিশুরা যেন পিছিয়ে না পড়ে
কোনো শিশুর মাতৃভূমি অন্য দেশ কিংবা সে ভিন্ন ধর্মের হলেও সে যেন সাঁতার শেখার সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে মুসলিম মেয়েদের শরীর ঢাকা সাঁতারের পোশাক ‘বুর্কিনি’ পরেই সাঁতার শেখার সুযোগ দেয়া হয়েছে জার্মানির একটি স্কুলে৷ জানান জার্মনির পরিবারমন্ত্রী ফ্রান্সিসকা গিফে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শিশুর মা-বাবাকেই বুঝতে হবে
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, জার্মানিতে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ শিশুই ঠিকমতো সাঁতার জানে না, যা আসলে বিপজ্জনক৷ মুসলিম মেয়েরা যাতে এ দেশের শিক্ষার নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সাঁতারের ক্লাসেও যাতে তারা অংশ নেয়, তা নিশ্চিত করারই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/M. Skolimowska
কিন্তু বাবাদের আপত্তি...
কিন্তু অনেক মুসলিম মেয়ের বাবা কোনোভাবেই মেয়েকে সাঁতার শিখতে দিতে রাজি নন৷ ফলে মুসলিম মেয়েদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ শিক্ষকরাই ডয়চে ভেলেকে এ কথা জানিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/ZB
জার্মান মেয়েদের লাইফস্টাইল তাদের অপছন্দ
জার্মানিতে বসবাসরত মুসলিমদের অনেকের কাছে জার্মান মেয়েদের জীবনযাত্রা বা পোশাক-আশাক এখনো গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি৷ এ কারণেও মুসলিম পরিবারের অভিবাবকরা তাঁদের মেয়েদের ব্যাপারে একটু বেশি রক্ষণশীল থেকে যাচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kalaene
যেখানে অনুমতি মিলেছে
জার্মানির নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের হ্যার্নে শহরের একটি স্কুলে মুসলিম মেয়েরা বুর্কিনি পরে সাঁতার শেখার অনুমতি পেয়েছে৷ ভাড়া দেওয়ার জন্য ২০টি বুর্কিনিও রাখা হয়েছে সেখানে৷
ছবি: DW
আর কোনো বাধা নেই...
২০১৩ সালে ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, বুর্কিনি অনুমোদন পেলে সাঁতার শেখার ক্লাসে মুসলিম মেয়েদের অংশ নেয়াও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করবে৷ হ্যার্নে শহরের স্কুলটিতে বুর্কিনি পরে সাঁতার শেখার অনুমতি দিয়ে দেয়ায় এবার হয়ত মুসলিম মেয়েদের সাঁতার শেখার পথে কোনো বাধা থাকবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
6 ছবি1 | 6
ইরানি শরণার্থীদের নিয়ে গঠিত দলটি মনে করিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘‘প্রতি বছর ইরানে হাজারও নারী পোশাকের রীতি ভাঙার কারণে শাস্তি ভোগ করছে৷''
প্রতিবছর বিশ্বে মুসলিম নারীরা ফ্যাশনের পেছনে ৪,৪০০ কোটি ডলার খরচ করে, যা ক্রমাগত বেড়ে চলছে বলে জানান জিল আলেসান্দ্রো৷ গত কয়েক বছর ধরে ‘ভোগ অ্যারাবিয়া'র মতো বিভিন্ন ফ্যশন ম্যাগাজিন এই বাজার তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে৷ এর সাথে তাল মিলিয়ে বড় বড় ব্র্যান্ড আর ডিজাইনাররা পোশাক বের করছেন৷ ২০১৫ সালে খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম প্রথমবারের মতো ‘হেডস্কার্ফ'পরিহিত নারীকে তাদের বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে৷ ডলচে অ্যান্ড গাবানা, ইউনিকলোর মতো ব্র্যান্ডগুলো মুসলিম নারীদের জন্য তাদের স্টোরে আলাদা পোশাক রাখছে৷
নতুন ধারণা
প্রদর্শনীর ধারণাটি প্রথম দিয়েছেন অস্ট্রিয়ান একটি জাদুঘরের পরিচালক ম্যাক্স হলিয়েন৷ ২০১৬ সালে সান ফ্রান্সিকোতে এই আয়োজনের যখন পরিকল্পনা করা হয় তখন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিরোধী মনোভাব বাড়ছিল৷ জার্মানিতেও এখন অনেকটা সেই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে৷ তবে প্রদর্শনীর এই আয়োজন তার প্রেক্ষাপটে নয় বলে জানান ডি আলেসান্দ্রো৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য নামিনি, বরং ফ্যাশন বিশ্বের একটি অসাধারণ অংশকে তুলে ধরছি যা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্ব উপেক্ষিত হয়ে আসছে৷''
কিন্তু তাদের এই যুক্তি মানতে নারাজ নারী অধিকার কর্মীরা৷ ‘‘বিশ্বজুড়ে যেসব মেয়ে আর নারীরা ‘হেডস্কার্ফ' পরতে চায় না কিংবা ছুড়ে ফেলতে চায় এই আয়োজন তাদের গালে চড় বসানোর মতো,'' ভোগ জার্মানিকে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নারী অধিকার সংগঠন ‘ট্যার ডে ফাম'-এর জার্মান পরিচালক ইঙ্গে বেল৷
‘কনটেম্পরারি মুসলিম ফ্যাশনস' এর আয়োজনটি ৫ এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে৷