জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ভাস্কর্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার৷ যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে যে কট্টর ইসলামপন্থিদের হাতে রেখেছিল ক্ষমতাসীন দল, তারা বলছে সেই ভাস্কর্য স্থাপন না করতে৷ আমার চিন্তা অবশ্য অন্যত্র৷
বিজ্ঞাপন
বঙ্গবন্ধুর যেই ভাস্কর্য নিয়ে এতকাল আওয়ামী লীগের হাতে থাকা কট্টর ইসলামপন্থিদের আপত্তি, সেটি বসানোর কথা ঢাকার দোলাইরপাড় মোড়ে৷ দক্ষিণাঞ্চলগামী বা ফিরে আসা মানুষদের সহজেই চোখে পড়বে ভাস্কর্যটি৷ ইতোমধ্যে সেই ভাস্কর্য চীনে তৈরি করে নিয়েও আসা হয়েছে৷ এখন শুধু সেটি বেদিতে বসানো বাকি৷
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৬ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উন্মোচন করার পরিকল্পনা ছিল৷ তবে, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নন৷
বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা যারা করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম৷ গত কয়েকবছরে এই গোষ্ঠীর নানা দাবি মেনেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ৷ আর তা দেখে জনমনে এমন এক ধারনা তৈরি হয়েছিল যে গোষ্ঠীটি ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ বিতর্কিত নির্বাচন জিতে আর বিরোধী দল, মতকে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা একটি দলের জন্য এরকম একটি শক্তিকে আয়ত্ত্বে রাখা জরুরি৷ আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সেটা ভালোভাবেই করতে পেরেছিল৷
কিন্তু, বিপত্তি সৃষ্টি করলো ভাস্কর্য ইস্যু৷ হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী হুমকি দিয়েছেন, যে কোনো দল ভাস্কর্য বসালে তা ‘টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে’, কেননা তার ভাষায়, তার ‘আব্বার’ ভাস্কর্যও যদি স্থাপন করা হয়, সেটা ‘শরিয়ত সম্মত হবে না’৷
বাবুনগরীর ‘আব্বার’ ভাস্কর্য অবশ্য তৈরি করা হয়নি৷ তবে যারটা তৈরি করা হয়েছে তিনি জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি৷ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা নিজেদের জাতির পিতার আদর্শের সৈনিক মনে করেন, তারা এমন হুমকি শোনার পরও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি৷ বরং তাদের আচরণে মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে একধরনের ভয় কাজ করছে৷ সেই ভয় কী ক্ষমতা হারানোর, নাকি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্যের, সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না৷
বরং যেটা দেখছি তাহচ্ছে, ভাস্কর্য ও মূর্তিকে আলাদা করার একটি চেষ্টা হচ্ছে৷ সরকারের নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেছেন, ‘‘ভাস্কর্য আর মূর্তি- দুটো এক জিনিস নয়, বিষয়টি নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হচ্ছে৷’’
খানের এই বক্তব্যে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ছে বলে আমার মনে হচ্ছে৷ তার বক্তব্যের একটি অর্থ হতে পারে মূর্তির বিরোধিতা করা যাবে, ভাস্কর্যের নয়৷ আর তিনি যদি আসলেই এমন কিছু বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তা বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থানের উপর একটি আঘাত হবে এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ যেসব ধর্মের অনুসারীরা উপাসনায় মূর্তি ব্যবহার করেন তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিঘ্নিত করার সুযোগ করে দেবে৷
এটা সত্য যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান৷ তবে, এটাও সত্যি ইসলাম একটি শান্তিপ্রিয় ধর্ম৷ আর বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের দেশ নয়৷ এই দেশে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ৷ এই দেশে সব ধর্মের মানুষেরই স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চার অধিকার ছিল, আছে এবং থাকবে৷
ভাস্কর্য আর মূর্তি এক বিষয়, নাকি আলাদা কিংবা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য না মূর্তি বসানো হচ্ছে দোলাইরপাড় মোড়ে - তা নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক, সমালোচনা হতে পারে৷ কিন্তু সংখ্যালঘুদের উপর যেন এর কোন বিরুপ প্রভাব না পড়ে৷ সরকার, রাজনীতিবিদ, ধর্মচিন্তাবিদসহ সকলের প্রতি এই অনুরোধ রইল৷
ভাস্কর্য: শিক্ষক ও পড়ুয়ারা যা বলছেন
ভাস্কর্য, না মূর্তি- এই বিতর্ক নিয়ে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে৷
ছবি: Privat
শিল্প এবং ধর্ম এখন সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক নাসিমা হক বলেন, শিল্পসাহিত্য বিকাশের এই যুগে ভাস্কর্য এবং মূর্তি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই৷ ভাস্কর্য অথবা অন্যান্য যে-কোনো শিল্প নিছকই একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতির মাধ্যম, যা একটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ শিল্পকে এখন আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই৷
ছবি: Privat
উদ্দেশ্যটাই মুখ্য
ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ৈ বলেন, ‘‘সবই আসলে ভাস্কর্য৷ পার্থক্যের বিষয়টি চলে আসে সেটি কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে৷ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য, তিনি আমাদের দেশের জন্য আইকনিক একজন ব্যক্তিত্ব৷ সুতরাং তাঁর ভাস্কর্যকে ধর্মীয়ভাবে দেখার সুযোগ আদৌ আছে বলে আমি মনে করি না৷’’
ছবি: Privat
এ বিতর্ক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে
ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসিমুল খবির বলেন, ‘‘ভাস্কর্য বা মূর্তির বিষয়টি বহু আগে থেকেই সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি ধর্মীয়ভাবে মীমাংসিত৷ এমনকি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতেও ভাস্কর্য আছে৷ সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি বাংলাদেশে এখন যে ঘটনাটি ঘটছে, সেটি একধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অহেতুক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পায়তারা ছাড়া কিছুই নয়৷’’
ছবি: Privat
সংজ্ঞাগত পার্থক্য সামান্য
ভাস্কর্য বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী মৃৎমন্দির গুঞ্জন কুমার বলেন, ‘‘কে কীভাবে ভাস্কর্যটিকে উপস্থাপন করছে, সেটিই মুখ্য বিষয়৷ মূর্তি এবং ভাস্কর্যের মাঝে দ্বান্দ্বিক কোনো পার্থক্য নেই৷ অনেক ভাস্কর্য আছে যেটি মূর্তি নয়৷ আসলে মূর্তি যখন অনুভূতি বা নান্দনিকতার জন্য তৈরি হয় তখন তা ভাস্কর্য হয়ে ওঠে৷’’
ছবি: Privat
শব্দ দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন
তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন লামিয়া নোশিন নকশি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘চারুকলার একজন ছাত্রী হিসেবে আমার মাথায় প্রথমেই যা আসে সেটা হচ্ছে শব্দ দুটির প্রেক্ষাপট এবং অর্থের ভিন্নতা৷ ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে কিছু ক্ষেত্রে মূর্তি নির্মিত হয়ে থাকলেও ভাস্কর্যের ব্যাপারটি পুরোপুরি শৈল্পিক৷’’
ছবি: Privat
ভাস্কর্যে নান্দনিকতা থাকে
তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সৌম্যক সাহা ধ্রুব বলেন, ‘‘মূর্তি এমন এক ত্রিমাত্রিক গঠন, যা কোনো কিছুকে মূর্ত করে, এটি বিমূর্ত নয়৷ পাশাপাশি মূর্তি যখন উপাসনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়, তখন তাঁকে প্রতিমা বলা হয়৷ মূর্তি বা প্রতিমা ভাস্কর্যেরই প্রকারভেদ৷ ভাস্কর্যে মূলত নান্দনিকতাটাই প্রাধান্য পায়৷’’
ছবি: Privat
ভাস্কর্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে
ভাস্কর্য বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী পল্লব সমাদ্দার বলেন, ‘‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজন ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ভাস্কর্য তৈরি করে আসছে৷ ভাস্কর্য এবং মূর্তির মাঝে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও আমার মনে হয় দুটি বিষয় শেষ পর্যন্ত একই সুতোয় গাঁথা৷’’
ছবি: Privat
যাহা পানি, তাহাই জল
চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী তাহসিনা ফেরদৌস রিনিয়ার মতে, কিছু বিখ্যাত শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে ভাস্কর্য নাকি মূর্তি এ নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্ব থাকলেও এই ধারণার ভিত্তি বা গোড়া কিন্তু একই৷ তিনি ভাস্কর্য এবং মূর্তির পার্থক্যের কথা এভাবে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘সকল মূর্তিই ভাস্কর্য, কিন্তু সকল ভাস্কর্য মূর্তি না৷’’
ছবি: Privat
অমিল আছে, কিন্তু দ্বন্দ্বপূর্ণ নয়
চারুকলার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাবিলা তাবাসসুম বলেন, ‘‘মূর্তি অবধারিতভাবে মানুষ বা প্রাণীর আকৃতি হলেও ভাস্কর্যে প্রাণী বা কাল্পনিক ধারণা ফুটে উঠতে পারে৷ ভাস্কর্য দৃশ্যমান শিল্পের একটি শাখা, যা তৈরি করার পদ্ধতি মূর্তি থেকে ভিন্ন৷ ভাস্কর্যে শিল্পের নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকবে এবং এর আকার যে-কোনো প্রকারের হতে পারে৷’’