1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মূলধারার গণমাধ্যমের বাইরে বিনোদনের নব-নিরীক্ষা

সঙ্গীতা ইমাম
১৬ জুন ২০২৩

আন্তর্জাতিকতাবাদের এ সময়ে মানুষ আজ বিশ্ব নাগরিক। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি- সব বিষয়ে সজাগ আজকের মানুষ।

ছবি: Daniel Reinhardt/dpa/picture alliance

তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে সকল তথ্য জানা ও সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ প্রতিটি মানুষের অধিকার। বহু দিন ধরেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক নানা সংবাদমাধ্যমে বহির্বিশ্বের খবর শুনে, এমনকি নিজের দেশের প্রকৃত খবরও এসব গণমাধ্যমে জেনে অভ্যস্ত ছিলেন আমাদের দেশের মানুষ।

ছোটবেলায় পত্রিকা পড়ার সময়ও দেখেছি রয়টার্স, এপি, এএফপি থেকে ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, বাংলার বাণীসহ নামী সব সংবাদপত্রে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহ করা হতো ।

সে সময়ে সংবাদ ছাড়াও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান করা হতো বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক দল পাঠিয়ে। এটা অবশ্য শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবেই সম্ভব। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের নির্বাচিত শিল্পীরাই কেবল এ ভ্রমণের সুযোগ পান। কিন্তু বর্তমান সময়ে যে কোনো ব্যক্তি নিজের সঙ্গীত-নৃত্য-আবৃত্তি-অভিনয় ভিডিও করে ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটকে প্রচার করতে পারেন। অনায়াসে বাংলাদেশে বসে একজন নৃত্যশিল্পী দেখতে পারছেন আফ্রিকার কোনো দেশের স্থানীয় নৃত্যশৈলী। এজন্য তাঁকে মূলধারার গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন নেই।  বিশ্ব দরবারে নিজের প্রতিভাকে প্রকাশ তাই এখন বড়ই সহজ এবং যেকেনো সাধারণ মানুষেরও সে সুযোগ আছে।

আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য বড় কষ্টের একটি ব্যাপার ছিল যে, বাংলাদেশে আমরা ভারতীয় অধিকাংশ চ্যানেল দেখতে পাই; কিন্তু ভারতে আমাদের কোনো চ্যানেল দেখানো হয় না। রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক নীতি নির্ধারকদের কারণেই এই বাধা। কিন্তু নেটফ্লিক্স, হইচই, চরকি, অ্যামাজন প্রাইমের মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো অনায়াসে সীমান্ত অতিক্রম করছে; বিনিময় হচ্ছে ভাবনা আর সৃজনবোধের। আমার দেশের সন্তান নানা দেশের গান শুনছে ইউটিউবে। কোরিয়ান বিটিএস ব্যান্ড এখন আমাদের তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সাউথ ইন্ডিয়ান ক্রাইম থ্রিলার ছবিগুলো এদেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ওটিটি প্লাটফর্মের কারণে। ফলে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, কিশোর বা তরুণদের মধ্যে একদিকে যেমন কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার প্রবণতা বাড়ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে তেলেগু বা মালায়লাম ভাষার প্রতি আগ্রহ। নানা ভাষা সংস্কৃতির সমন্বিত অভিজ্ঞতায় আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন ঋদ্ধ হচ্ছে।

একটা সময় বিশ্বচলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতাদের ছবি দেখার জন্য আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল ছিল দূতাবাসগুলোর সংস্কৃতি বিভাগ। আমি নিজেই যেমন আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি প্রথম দেখেছিলাম বাংলাদেশের জাপান দূতাবাসে, জাপান ফিল্ম সেন্টারের উদ্যোগে। তারাকোভস্কির রেট্রোস্কেটিভ দেখেছিলাম রাশান কালচারাল সেন্টারে। কিন্তু এ সুযোগগুলো প্রায় সব দেশেই কেবল রাজধানী বা মেট্রোপলিটন শহরে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আজকের দিনে ওটিটি প্লাটফর্মের কারণেই এ সুযোগ সকলের হাতের মুঠোয় পৌঁছে গেছে। মুবির (Mubi) মতো প্লাটফর্মের কারণে কেবল ছবি দেখা নয়, তার তুলনামূলক আলোচনা পড়ারও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে যদি ব্যবসার কথাও চিন্তা করি, তাহলেও বলতে হবে, ওটিটি চলচ্চিত্রের বাজার বড়ো করেছে। বিশ্ব চলচ্চিত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সাথে, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাও তৈরি হচ্ছে। তখন শিল্পীরও পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা সময় ফেস্টিভাল না হলে এক দেশের নির্মাতার সঙ্গে অন্যদেশের অভিনয়শিল্পীর দেখা হওয়াটা কঠিন ছিল; এখন ওটিটির হাত ধরে নিমেষেই একদেশের ভালো অভিনয়শিল্পী পৌঁছে যাচ্ছেন অন্যদেশের বড়ো নির্মাতার চিত্রনাট্যে। দুদেশের জন্যই এটা সুখবর। আবার ওটিটির যে বাজার, তা কেবল চলচ্চিত্রের বাজার বলে আমি মনে করি না। অর্থাৎ একসময় সিনেমা বিজনেজ বলতে কেবল সিনেমায় বিনিয়োগটাই বোঝাতো; কিন্তু এখন তার ক্ষেত্র বেড়েছে। নতুন যে কোনো মোবাইল বা ট্যাব আসলে প্রথমেই জানানো হয়, তাতে ভিডিও দেখার সুযোগ-সুবিধা কেমন। প্রযুক্তিখাতেও এ গবেষণাগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। একটা সময় কেবল ভিডিও গেইমের জন্যই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কথা ভাবা হতো, এখন চলচ্চিত্র সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, মানুষের বিনোদন এখন মোবাইলভিত্তিক। একে মাথায় রেখেই সাজানো হচ্ছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত গবেষণাগুলো। আবার সিনেমা-প্রযুক্তিও তৈরি হচ্ছে ওই ছোট্ট ডিভাইসটিকে মাথায় রেখেই। ফলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেকগুলো ধাপে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ছবি লগ্নিকারকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এ বাজারের প্রাসঙ্গিকতা অনেক। বাংলা ছবির প্রেক্ষিতটাই যদি বিবেচনা করি, সিনেমা হলে ছবি ফ্লপ করার উদাহরণ অনেক আছে। টেলিভিশনের যুগ যখন রমরমা, তখন কিছু সিনেমা হলে না চললেও তার টিভি প্রিমিয়ার হতো।  হয়তো প্রযোজকের টাকাটা তখন উঠে আসতো। কিন্তু টেলিভিশন তো কেবল বিনোদনমাধ্যম নয়, সুতরাং সেখানে প্রতিযোগিতা ছিল প্রবল। হয়তো বছরে দুই কি তিনটি ছবির টিভি প্রিমিয়ার হয়েছে। কিন্তু ওটিটি যেহেতু সিনেমাকেন্দ্রীক এবং বর্তমানে বড়ো প্রযোজনা সংস্থাগুলো সকলেই ওটিটিতে চলে এসেছেন, তাই এখানে সিনেমায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজককে অতো আশংকায় থাকতে হবে না। বাংলাদেশে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম একটি বড়ো প্রযোজনা সংস্থা। এতদিন তাদের প্রযোজিত ছবিগুলো হয় হলে গিয়ে দেখতাম, নাহয় চ্যানেল আইতে টিভি প্রিমিয়ার হলে দেখা হতো। সম্প্রতি তাদের ওটিটি প্লাটফর্ম আইস্ক্রিন চালু হবার পর আমাকে আর টেলিভিশন সূচির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। একজন দর্শক তার সময় ও পছন্দ মতো তার সুবিধা অনুযায়ী তাদের প্রযোজিত ছবিগুলো দেখে নিতে পারবেন।

আবার মূলধারার গণমাধ্যমের কিছু সূচক আছে। তাকে গ্রহণ করা বা না করার সঙ্গে কতগুলো রাজনৈতিক সমীকরণ জড়িত। রাজনৈতিক কারণে গণমাধ্যমের সীমানাও তাই নানা রকম হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ওটিটির পরিসরটা বড়ো নিঃসন্দেহে। ফলে এখানে সহজেই নানা মতের বা আদর্শের নির্মাতাদের কাজ দেখা যায়। যদিও রাজনীতি বা রাজনৈতিক আদর্শ অনেক বড়ো বিষয়; সে তুলনায় ছোট্ট এই ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা কম নয়।

সঙ্গীতা ইমাম, শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীছবি: Sangeeta Imam

তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, সিনেমা হলের যুগ কি তবে শেষ হতে চলল? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ‘না'। বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে এটা ঠিক, কিন্তু কনটেন্ট  কমছে- এটা বলা যাবে না। সিনেমা হলের অভিজ্ঞতা সম্ভবত রূপান্তরিত হচ্ছে। আজকের দিনে ব্যক্তিমানুষের ব্যস্ততা, নাগরিক ঝঞ্ঝাট, জ্যামের সাতকাহন এসব পেরিয়ে সিনেমা হলে যাবার ঝক্কিটা অনেকেই নিতে চান না। কিন্তু বড়ো পর্দার অভিজ্ঞতা তো অতুলনীয়। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটি বড়ো ভূমিকা পালন করছে বলে আমি মনে করি। এই কদিন আগেই দেখলাম, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল একটি নতুন পণ্য এনেছে অ্যাপল ভিশন প্রো নামে। আমি প্রযুক্তির মানুষ নই, কিন্তু তাদের বানানো পণ্যের ভিডিওগুলো দেখে মনে হলো, ঘরে বসে সিনেমা হলের অনুভূতি নিয়ে চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতাকে তারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে। সুতরাং সিনেমা হলটা ঘরে-বাইরে দুদিকেই থাকবে, মানুষ তার প্রয়োজন মতো সেটা ব্যবহার করবে।

সবশেষ কথা কনটেন্ট। ওটিটির কনটেন্ট নিয়ে নানা আলোচনা চলে চারদিকে। সেদিনই এক বন্ধু জানালেন, ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম উল্লুর (Ullu) কথা। তার বক্তব্য অনুযায়ী, এই প্লাটফর্মের অনেক কনটেন্টই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, ওটিটি বা ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্মগুলো ধরে আমাদের কি সেই পুরোনো সেন্সর নীতিমালায় এগুনোর কোনো রাস্তা আছে? আমার স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে নেই। সেন্সর আদতে কোনো সমাধান  বয়ে আনে না। যুগ পাল্টেছে, সময় বদলেছে। আজকের দিনে কোনো কিছুকে নিষিদ্ধ করে রাখার কোনো সুযোগ নেই, কারণ মানুষের হাতে অফুরান উপায় আছে সেই বিষয়টিকে দেখার বা জানার। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, শিক্ষার যথার্থতাই পারে মানুষের মধ্যে ঔচিত্যবোধটি তৈরি করতে। ‘এডাল্ট কনটেন্ট' বলতে আমরা সারাজীবন নিষিদ্ধ কনটেন্টকেই জেনে এলাম, যেটা ভুল। নিষেধটা কে করছেন? কেনো করছেন? কিংবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিষেধ করলেই সেটা শুনতে আমি বাধ্য কি? এসব প্রশ্নের নিরিখে উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, উত্তরটি সহজ নয়। তাই শিক্ষার পদ্ধতিটি বদলানো প্রয়োজন। যেনো একজন মানুষ নিজেই বুঝতে পারেন তার ভালো-মন্দের পরিধি কতখানি, তার রুচির রকমফেরটি কেমন। ফলে আমি মনে করি, পাঠ্যসূচিতে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক বিষয়গুলো যোগ করা উচিত। সেক্ষেত্রে যাারা বিনোদন জগতের মানুষ, তাঁদেরও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

সঙ্গীতা ইমাম বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মী
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ